In the Quaqgmire of Inane Politics

বাংলাদেশ : বড় দুই দল শোধরাবে কবে?

আবুল মোমেন

অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে ছাত্রলীগ সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যে হারে বিব্রতকর পরিিস্থতি সৃষ্টি করেই চলেছে, তাতে দল ও সরকারে জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দের অসন্তোষ চাপা থাকছে না। খোদ প্রধানমন্ত্রীও শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন অপরাধীদের দল বিবেচনায় না নিয়ে ধরার নির্দেশ দিতে। তাতে সরকারের শুভানুধ্যায়ীরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন, এবার বোধ হয় ক্ষমতার বেপরোয়া অপপ্রয়োগ ও অপরাধের মাত্রা কমে আসবে।

কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে অতিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীর উক্তির ঝাঁজ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে উবে গেছে কি না। প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি এবারে কোমর বেঁধে নামতে চেয়েছিল আন্দোলনে। মূল লক্ষ্য ছিল গত বছরের ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে গণ–আন্দোলন সৃষ্টি। তার মহড়া হিসেবে ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুরে ডেকেছিল জনসভা। তাদের ইচ্ছা ছিল সারা দেশ থেকে কর্মী সমাবেশ করে শক্তি প্রদর্শন করা, তার মাধ্যমে সমর্থকদের চাঙা করা এবং সরকারকে আপোসের পথে আসার বারতা দেওয়া। তাদের পরিকল্পনা একা ছাত্রলীগই বানচাল করে দিয়েছে। কয়েকটি মোটরসাইকেল র‍্যালি, প্রতিপক্ষের মিছিলে একটি-দুটি হামলায় ওরা কার্যসিদ্ধি করেছে। মাঠ তথা রাজপথ থেকে বিএনপি ও ২০ দলের কর্মীদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। এভাবে বলার অর্থ ছাত্রলীগের অপকর্মকে সমর্থন নয়। আমরা বিষয়ের আরেকটু গভীরে যাব।

বিএনপি আপাতত দুই কদম পিছিয়ে আসার কৌশল নিয়েছে এবং নেতৃবৃন্দ আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, বিএনপি কোনো সন্ত্রাসী দল নয়, নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক দল। ছাত্রলীগের লাঠিসোঁটা, পিস্তল-কাটা বন্দুকের বিরুদ্ধে ওরা সশস্ত্র লড়াই করবে না। এর ওপরে সরকারের হাতে আছে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনী, যারা নিজেরাও আক্রমণ চালায় এবং আক্রমণকারী ছাত্র-যুবলীগের গুন্ডাবাহিনীকে সহায়তা দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ একেবারেই অসম রণাঙ্গন—বিএনপি ও তার সহযোগীদের জন্য।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জবরদস্তি নির্বাচনের সময় বিএনপির নেতৃত্ব খুবই আশা করেছিল– যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা দেশ, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ এবং চীন ও জাপানের মতো বাংলাদেশের উন্নয়নে এশীয় অংশীদারদের সমর্থন পাবে। এমন একটা একতরফা নির্বাচন তারা সমর্থন করবে না, জবরদস্তি নির্বাচন হয়ে গেলেও অন্তত পরবর্তীকালে নতুন সরকার আন্তর্জাতিক মহলের অনুমোদন পাবে না। সত্যিই এসব দেশ এ নির্বাচন, নির্বাচিত সরকারকে আন্তরিকভাবে সমর্থন জানাতে কুণ্ঠা বোধ করে। কিন্তু তারাও নিরুপায়। এ কেবল তাদের পুঁজি লগ্নির স্বার্থ বা কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতার বিষয় নয়। তাদের জন্য বড় সমস্যা ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর গাঁটছড়া। দুর্ভাবনার কারণ বিএনপি-জামায়াতের বিগত শাসনামলে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা ও তাদের সঙ্গে সরকারি ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ।

দেখা যাচ্ছে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপি ভরসা পায় না, আন্দোলনের জন্য নিজেদের চেয়ে জামায়াতের কর্মীদের ওপর তাদের ভরসা বেশি, আর ভোটের ক্ষেত্রে জামায়াতের ৫-১০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন অনেকগুলো আসনে ফলাফল প্রভাবিত করে থাকে। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের ও তাদের দলকে সমর্থন দিয়ে বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রাখছে। দ্বিতীয়ত, ২০০১-২০০৬ আমলে সংঘটিত মারাত্মক সব জঙ্গি সন্ত্রাসের ঘটনার কোনো স্পষ্ট জবাব তারা দেয়নি, তাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী, হাওয়া ভবন ও তারেক জিয়ার ভূমিকা নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, তারও সদুত্তর দলটি দিতে পারেনি। ফলে ধর্মান্ধতার পাশাপাশি জঙ্গিবাদের প্রশ্নেও দলের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে।

এই অবস্থানে থেকে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃঢ় সমর্থন আশা করা বৃথা, কারণ আজকের দিনে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ, যার মূল প্রবক্তা, হোতা ও কুশীলব কট্টরপন্থী মুসলিম গোষ্ঠীগুলো থেকেই আসছে। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলে যেসব সংগঠনকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাদের সমর্থক, সদস্য, এমনকি সাংগঠনিক কিছু কাঠামোর অস্তিত্ব বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। এসব সংগঠন ও ব্যক্তি এবং বাংলাদেশ সরকার যেসব সংগঠনকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের দায়ে নিষিদ্ধ করেছে সেগুলোর সঙ্গে জামায়াত বা বিএনপির কোনো কোনো নেতার সংশ্লিষ্টতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপির পক্ষে গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃঢ় সমর্থন আশা করা উচিত হবে না।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম দেশের আদত সমর্থন তাদের পক্ষে থাকলেও এই দেশগুলো অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে প্রায় পশ্চিমের তাঁবেদার দেশ। তাদের বাইরে গিয়ে প্রকাশ্যে কোনো দলকে সমর্থন জানানো এদের পক্ষে সম্ভব নয়, বড়জোর গোপনে অর্থসাহায্য জোগাতে পারে। তাতে বিএনপির বিশেষ ফায়দা হবে না। আর জাপান পশ্চিমের অন্ধ অনুসারী দেশ, চীনের কাছে বর্তমানে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থই মুখ্য বিষয়। সেদিক থেকেও বিএনপি কার্যকর সমর্থন আশা করতে পারে না। এর বাইরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অংশীদার আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ, যেমন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইউএনডিপি, ইইউ এবং দ্বিপক্ষীয় সংস্থাগুলোর মনোভাব ও অবস্থানও একই রকম থাকবে। নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে আপত্তি ও সমালোচনা করলেও দেশ ও সরকারকে অনিশ্চয়তায় ফেলবে না তারা। কারণ তাতে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে।

এ কথাও বলা দরকার, দেশের সিংহভাগ সচেতন ও বিবেকবান মানুষ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার দাপট ও অপব্যবহার, লুটপাট, খুনখারাবি, দখলবাজিতে অতিষ্ঠ, বিরক্ত এবং তার প্রতিকার চায়। অনেকের মনে এসব দেখেশুনে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের অরাজক অবস্থার স্মৃতি ফিরে আসছে। তার দায় তো সে সময়ের আওয়ামী লীগ এড়াতে পারেনি।

ঠিক আগের মতোই যেন আওয়ামী লীগের উচ্চাভিলাষী কর্মীরা বিরাজমান বাস্তবতায় তাদের জন্য যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা লুফে নিতে উদ্গ্রীব। আর তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সমাজের সুযোগসন্ধানী নীতিহীন বেপরোয়া মানুষেরা। আইন বাঁচল কি না, গণতন্ত্র ক্ষুণ্ন হলো কি না, দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হলো কি না ইত্যাদি ব্যক্তিস্বার্থের যূপকাষ্ঠে বলি দিতে তারা ব্যস্ত। এই আখের গোছানোর দলকে চুয়াত্তর-পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ‘চাটার দল’ বলে আক্ষেপ করেছিলেন, কিন্তু কিছুতেই তাদের নিরস্ত করতে পারেননি। এর ফলে তিন বছরের মাথায় সরকারের জনসমর্থন বেশ কমে গিয়েছিল। আর ঠিক তখনই প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রত্যাঘাতটা এসেছিল। আমরা লক্ষ করছি, আওয়ামী লীগ বর্তমানে জনসমর্থনের ওপর ভরসা করতে পারছে না এবং পুলিশ, র‍্যাব, গোয়েন্দানির্ভরতা বেড়ে চলেছে এবং অবাধ নির্বাচনে বিজয়ের ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয়ে ভুগছে তারা নিজেরাই

এই অবস্থায় দেশের মানুষ পড়েছে বিপাকে। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গিদের প্রতি তাদের মনোভাব অস্পষ্ট রেখে বিএনপি এ দেশে ক্ষমতায় আসুক—এটা জনগোষ্ঠীর বড় অংশ চায় না এবং তারা এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকবে না, যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং জঙ্গিবাদ বিরোধিতায় তারা দীর্ঘদিন ধরেই মাঠপর্যায়ে সক্রিয় ছিল এবং এখনো আছে। এত দূর এগিয়ে তারা এখন পিছু হটতে রাজি নয়। আওয়ামী লীগের হঠকারিতা সত্ত্বেও গণজাগরণ মঞ্চের বারতা দেশের তরুণসমাজকেও এ পক্ষে শামিল করেছে। কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন এই জনগোষ্ঠী টেন্ডারবাজ, দখলদার, লুটেরা, খুনজখমে অভ্যস্ত হয়ে পড়া ছাত্রলীগ-যুবলীগের সেসব কর্মীর কর্মকাণ্ডের সমর্থক হতে পারে না। আওয়ামী লীগ নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় টিকে থাকছে বস্তুত বিএনপির ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে।

দেশকে শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হলে বিএনপিকে শোধরাতে হবে তার রাজনীতি, ছাড়তে হবে জামায়াত ও ধর্মান্ধ দলের সংস্পর্শ, স্পষ্ট করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান। একই কারণে আওয়ামী লীগকে শোধরাতে হবে তার কিছু নেতা ও অনেক কর্মীর ক্ষমতার অপব্যবহার, মারাত্মক অসহিষ্ণুতা, দখলদারের মানসিকতা, বেআইনি উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার প্রবণতা।

দেশে রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তির শূণ্যতার আকালে নাগরিক সমাজেরই বড় দুই দলকে সঠিক পথে রাখার কাজে অভিভাবকত্ব করার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনেরা ব্যক্তিগত লাভের মোহে পড়ে জনসমর্থনের বিচারে আকারে বড় কিন্তু মূল্যবোধের বিচারে ক্ষয়িষ্ণু দুটি দলের কাছে আত্মবিক্রয় করে বসে আছেন। বাংলাদেশের জন্য এটিই সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

Tags: , , , , , , , ,

Leave a comment