Road to Destruction

সর্বনাশের যাত্রাপথ

শ্যামল চক্রবর্তী

ধর্মের দাপটে সর্বনাশ হয়েছে পৃথিবীর নানা সভ্যতায় অনেক বিজ্ঞানীর। এই সর্বনাশের তালিকায় রয়েছেন সার্ভেটাস, আবদুল লতিফ, চার্বাক। রয়েছেন গ্যালিলিও, ব্রাহে, ব্রুনো। গ্যালিলিওকে নিয়ে চর্চা হয়েছে অনেক। বেশ কয়েক বছর আগে পোপ বললেন, গ্যালিলিওকে শাস্তি দেওয়া অন্যায় হয়েছে আমাদের। দিনকয় আগে পোপ ফ্রান্সিস যা বললেন, পৃথিবী চমকে উঠেছে। তিনি ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে সমর্থন করলেন। স্টিফেন হকিংয়ের বিগ ব্যাং তত্ত্ব মেনে নিলেন। সব চেয়ে বড় কথা, বললেন ফ্রান্সিস, ‘ঈশ্বর জাদুকর নন’। মনে পড়ে আমাদের, অনেকদিন আগে আইনস্টাইনের একটি কথা আমাদের বুকে আলোড়ন তুলেছিল। ‘ঈশ্বর দাবা খেলোয়াড় নন।’ তবে আইনস্টাইন আর পোপ ফ্রান্সিস কি একই কথা বললেন?

বছর কয় আগের কথা। ভ্যাটিকান থেকে বলা হয়, বিজ্ঞানের সত্য যাচাই করার নিয়ম বিজ্ঞানেই রয়েছে। ধর্মকে সেখানে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। ধর্মের কাজ কি তবে? বিজ্ঞান যখন মানুষের কল্যাণের সত্য আবিষ্কার করে, সেই সত্য কেমন করে মানুষের জীবনে কাজে লাগানো যায়, ধর্মকে সেই পথ আবিষ্কার করতে হবে।

ডারউইনের লাঞ্ছনার কথা আমাদের অজানা নয়। বিবর্তনের কথা বলেছিলেন ডারউইন। ডারউইনের আগে বিবর্তনের কথা কি আর কেউ বলেননি? বলেছেন বই কি। ডারউইনের দাদু এরাসমাস ডারউইন বলেছেন। লামার্ক বলেছেন। আরও কেউ কেউ বলেছেন। তবে ডারউইন এমনভাবে আক্রান্ত হলেন কেন? কারণ সহজ। ডারউইনের আগে বিবর্তন নিয়ে যাঁরা বলেছেন, তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিবর্তন ‘কেমন’ করে হয়? ভ্যাটিকানের অভিমত, এতে আমাদের আপত্তি নেই। বিবর্তনের পথ আবিষ্কার করুন বিজ্ঞানীরা, আমাদের এতে ঝগড়া করার কিছু নেই। ডারউইন যে ভিন্ন কথা বলছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘কেন’ বিবর্তন হয়? কিভাবে হয়, বললে পোপের আপত্তি নেই। কেন হয়, বললে আপত্তি আছে। ঈশ্বরের ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন ডারউইন। একথা ভ্যাটিকান মানবে কেন? ঈশ্বরই তো তার অভিলাষ পূরণে নানা জীব প্রজাতিকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।

একই কাণ্ড হকিং-র বেলায়। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির দুটি তত্ত্ব। ফ্রেড হয়েলের ‘স্টিভি স্টেট থিওরি’। স্থির দশা তত্ত্ব। হকিং-র ‘বিগ ব্যাং তত্ত্ব’। হয়েল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মুহূর্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। সৃষ্টির পর কী ঘটছে হয়েল বুঝতে চাইছেন। ভ্যাটিকানের আপত্তি নেই। হকিং যে বেয়াড়াপনা করছেন। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মুহূর্ত বুঝতে চাইছেন। এত স্পর্ধা মেনে নেওয়া যায় না। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বরের সৃষ্টি। সৃষ্টির সত্য মেনে নিয়ে যে বিজ্ঞানী যে কাজই করুন না কেন, পোপের কোনো আপত্তি নেই। হকিং যা বলছেন তাতে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির ফলে ঈশ্বরের ভূমিকাকে নস্যাৎ করতে চাইছেন। এমন বেয়াদপি মানা যায় না। অথচ আজ ফ্রান্সিস তাই মেনে নিলেন। তিনি ডারউইন ও তাঁর বিবর্তন তত্ত্বকে মেনে নিলেন। হকিং ও তাঁর বিগ ব্যাং তত্ত্ব মেনে নিলেন। বিজ্ঞানের সত্যকে পোপ অবজ্ঞা করতে পারছেন না। বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে একবিংশ শতাব্দীতে পোপকেও মানতে হচ্ছে।

আমরা যারা বিজ্ঞান সংস্কৃতির কথা বলি, আমাদের কাছে এ পরম সুখবর। তবে হালে দিল্লিতে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তাদের কাছে সুখবর নয়। সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় ভাবনায় পরিচালিত হয় যারা, অন্য ধর্মে ঔদার্যের বিকাশ দেখলে গায়ে জ্বালা ধরে। লড়াইটা তাহলে জমবে কেমন করে? লজ্জা হয় আমাদের ভাবতে। ২০১৩ সালের ২০শে আগস্ট পুণে শহরে দিনের আলোয় খুন হলেন ডাঃ নরেন্দ্র দাভোলকার। রাজনীতির কর্তারা ছুটে গেলেন। একজন তো বলেই ফেললেন, গান্ধীজীর হত্যাকাণ্ডের চেয়েও এই হত্যাকাণ্ড ভয়ঙ্কর। কিন্তু ঘটনা এই, খুনিদের কেউ আজও ধরা পড়েনি। একুশ শতকে বিজ্ঞানের কোনো সত্য আবিষ্কার হলেই কোনো কোনো ভারতীয় প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করেন, ‘এ আর এমন নতুন কথা কী। ভারতে পুরানো আমলেই এই সত্য আবিষ্কার হয়েছে।’ এমন উন্মাদ দর্শন কত কাল চলবে এ দেশে? কত কাল চলবে এমন উন্মাদের পাঠক্রম?

আমাদের দেশে ‘ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদ’ (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ) নামে একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিছুদিন হলো সেখানে ওয়াই সুদর্শন রাও নামে এক ভদ্রলোক সভাপতি পদে যোগ দিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানে খ্যাতনামা ঐতিহাসিকেরা থাকবেন, এ কথাই আমরা সকলে মনে করি। যিনি সকলের মাথার উপরে বসলেন তিনি কেমন ঐতিহাসিক? দু-চার কথা বললে ভালো হয়।

এখন যে নতুন রাজ্য তেলেঙ্গানা হয়েছে তার ওয়ারাঙাল জেলার কাকাতিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করতেন। ১৯৭৬ সালে তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়। বছর চল্লিশ হতে চললো। শুরু থেকে তিনি সেখানেই রয়েছেন। ঠিকানা বদল করেননি। ২০১৪ সালের জুলাই মাস থেকে ইতিহাস গবেষণা পরিষদের প্রধান পদে যোগ দিয়েছেন। তিনি গোটা চল্লিশেক গবেষণাপত্র লিখেছেন বলে দাবি করেছেন। ঐতিহাসিক রমিলা থাপার বলেছেন, ভারতীয় মহাকাব্য নিয়ে কিছু জনপ্রিয় রচনা লিখেছেন সুদর্শন রাও। গবেষণাপত্র বলতে যা বোঝায়, সেগুলো তা নয়। ১৯৭২ সালে খ্যাতনামা ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা ও আরও কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছিলেন একটি সোসাইটি। এই সোসাইটি পরে কেন্দ্রীয় উচ্চশিক্ষা মন্ত্রকের আনুকূল্য লাভ করে। তৈরি হয় ‘ইতিহাস গবেষণা পরিষদ।’ এই পরিষদের সভাপতি ছিলেন রামশরণ শর্মা, নীহাররঞ্জন রায়, ইরফান হাবিব, রবীন্দ্র কুমার, কে এস লাল, ডি এন ত্রিপাঠী ও সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতো বিশিষ্ট ঐতিহাসিকেরা। এখন যিনি এলেন, দেশের কোনো নামজাদা ঐতিহাসিক তাঁকে ‘ইতিহাসবিদ’ হিসেবে চিহ্নিত করতে রাজি নন।

রাজ্য দু’ভাগ হবার আগে অন্ধ্র প্রদেশে ‘অখিল ভারতীয় ইতিহাস সঙ্কলন যোজনা’ নামে ১৯৭৮ সালে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শাখা সংগঠন। কী কাজ হবে এই সংগঠনের? ‘জাতীয়’ আলোকে ভারতের ইতিহাস রচনা করতে হবে। মরুপথ পিংলে নামের একজন সঙ্ঘ প্রচারকের মাথায় প্রথম এমন একটি সংগঠন গড়ার ভাবনা জন্ম নিয়েছিল। তাদের অভিযোগ, ব্রিটিশ রাজত্ব এ দেশের ইতিহাস ধ্বংস করেছে। স্বাধীনতার পর যারা ইতিহাস চর্চা করছেন তারা ব্রিটিশদের পথেই হাঁটছেন। দেশের ‘সঠিক’ ইতিহাস তাই আজও রচিত হয়নি। সে ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে। তাদের ভাষায়, ‘দুর্নীতি মুক্ত পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক’দের তাঁরা সে ইতিহাস রচনার কাজে লাগাবেন। এই যে সংগঠনটির কথা বলছি আমরা, তার অন্ধ্র প্রদেশ শাখার প্রধান ছিলেন ওয়াই সুদর্শন রাও। দিল্লিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক কেন্দ্রের কার্যালয়ে এদের মূল কার্যালয় রয়েছে

২০১৪ সালের আগস্ট মাসে সংগঠনের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চারটি বড় গবেষণা প্রকল্পের কাজ তারা শেষ করেছেন। সরস্বতী নদীর মূল পথ আবিষ্কার করেছেন। আর্যরা যে এ দেশেই ছিল, বাইরে থেকে আসেনি, সে কথা প্রমাণ করেছেন। মহাভারত, শঙ্করাচার্য ও বুদ্ধদেবের সঠিক সময়কাল নির্ণয় করেছেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ এ দেশের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ, একথাও নাকি প্রমাণ করেছেন তারা। ইতিহাসের কেমন পাঠগ্রহণ করে ‘ঐতিহাসিক’ শিরোপা পেয়েছেন সুদর্শন রাও, আমাদের বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় না।

সভাপতি হিসেবে যোগ দেওয়ার পর সুদর্শন বিতর্ক তুলেছেন। রামায়ণ ও মহাভারতকে ভারতীয় সভ্যতার ‘তথ্যের আকর’ বলে মানতে হবে। মহাকাব্য ভাবলে চলবে না। ওখানে কোনো ‘মিথ’ নেই, সবই ‘বাস্তব’। ২০১৪ সালের ১৭ই নভেম্বর ‘ইকোনমিক টাইমস’ পত্রিকায় সুদর্শনজির একটি সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে। একটি প্রশ্নের তিনি কী উত্তর দিয়েছেন আমরা দেখব। বাকি প্রশ্নোত্তর আগ্রহী বন্ধুরা দেখে নেবেন।

সাংবাদিক বন্ধু মন্তব্য করলেন, ‘ঐতিহাসিক রমিলা থাপার বলেছেন, উল্লেখযোগ্য কোনো জার্নালে আপনার কোনো গবেষণাপত্র নেই। আপনার এই পদে নিয়োগ একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’ উত্তেজিত সুদর্শন রাও উত্তরে বললেন : ‘ও তার অভিমত। আগের কোনো সভাপতির বিষয়ে কি তিনি এই প্রশ্ন তুলতে পারবেন? ইরফান হাবিবের বেলায় কি এই প্রশ্ন করা হয়েছে? তিনি তো দু’বার ‘আই সি এইচ আর’ (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টোরিকাল রিসার্চ)-র সভাপতি ছিলেন। কোনো গণমাধ্যম তো তাঁর কাছে সেদিন জানতে চায়নি তিনি কি মার্কসবাদী না কংগ্রেসের সঙ্গে আছেন? রমিলা থাপার একজন ঐতিহাসিক। আমিও একজন ঐতিহাসিক। আই সি এইচ আর-র সভাপতি পদে যোগ দিতে গেলে কি ঐতিহাসিকদের কাছে শংসাপত্র নিতে হবে? সরকার আমায় নিয়োগ করেছে। কোনো রাজনৈতিক দল নিয়োগ করেনি।’

না সুদর্শনজি, ঐতিহাসিকদের শংসাপত্রের প্রয়োজন নেই। যাই থাকুক আপনার রাজনৈতিক অভিমত, ঐতিহাসিকেরা জানুক যে আপনি একজন ঐতিহাসিক। সে কথাই তো তাঁরা বুঝতে পারছেন না।

ইরফান হাবিবের বামপন্থী ভাবনার কথা সকলেই জানেন। মনে পড়বে সকলের, আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদী একটা অংশের তাণ্ডব চলছিল দীর্ঘকাল। বিশিষ্ট বহু অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ইরফান হাবিব যাননি। একদিন মৌলবাদীদের হাতে চরম নিগৃহীত হন তিনি। জীবন সংশয়াপন্ন হয়ে পড়ে। পৃথিবীর বহু দেশের নামজাদা ঐতিহাসিকেরা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দাবি করে প্রতিবাদপত্র পাঠান। তারপর একসময় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতি ফিরে আসে। হোন তিনি বামপন্থী, হোন তিনি কংগ্রেসের মানুষ, তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় ঐতিহাসিক, বাকি পরিচয় তাঁর এক্ষেত্রে গৌণ।

সুদর্শনজি, আপনি ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মার্কসবাদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের দোষারপ করেছেন। ইতিহাস চর্চার তাই ‘ভারতীয়করণ’ চাইছেন। আপনার মনে পড়বে নিশ্চয়ই বার্ট্রান্ড রাসেলের কথা। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস বইয়ে কার্ল মার্কসকে নিয়ে লিখেছেন রাসেল। রাসেল কোনোকালেই মার্কসপন্থী নন। তাঁর রচনায় সেই সমালোচনার ধারা রয়েছে। শেষে তিনি কি লিখলেন? নিবন্ধ রচনায় তাঁর বিশ্লেষণভঙ্গি মার্কস অনুসৃত পথই অনুসরণ করেছে। আমরা বলি, বিজ্ঞান কোনো ‘বিষয়’ নয়। বিজ্ঞান হলো ‘পদ্ধতি’। ‘ইতিহাস’-কে যদি ‘বিজ্ঞান’ হয়ে উঠতে হয়, তবে ‘পদ্ধতি’ মানতেই হবে। নইলে জ্ঞান চর্চার মণিমানিক্য তৈরি হয় না। তৈরি হয় সভ্যতার জঞ্জাল

মহাকাব্য ও পুরাণের গল্পগাথায় আধুনিক বিজ্ঞানের অনুসন্ধান একদল মানুষ বহুকাল ধরেই করে চলেছেন। এদের এই অনুসন্ধিৎসা বিজ্ঞানমনন দিয়ে পরিচালিত হয় না। ঐতিহাসিক চেতনা দিয়ে অনুসৃত হয় না। কুয়াশাচ্ছন্ন দর্শনবোধে আচ্ছাদিত হয়ে সংগঠিতভাবে এরা এমন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। সুদর্শন রাও তাদেরই একজন। বিজ্ঞানীরা অনেকেই এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক করেছেন। পণ্ডিচেরী আশ্রমের অনিলবরণ রায়ের নিবন্ধের জবাব দিতে গিয়ে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে বিদ্রূপাত্মক সুরে একবার লিখতে হয়েছিল, ‘সবই ব্যাদে আছে’। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতের একাধিক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এমন বিকৃতির আশঙ্কায় আমাদের সতর্ক করেছেন। বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার বলছেন, ‘আমরা প্রায় সময়েই শুনতে পাই, আমাদের প্রাচীন পূর্বসূরিরা বর্তমানকালের আধুনিক বিজ্ঞান অধিগত করেছিলেন, আধুনিককালের নানা প্রযুক্তিও তাদের হাতে উদ্ভাবিত হয়েছে। …. প্রাচীন দর্শন গ্রন্থে কোয়ান্টাম তত্ত্ব, স্ট্রিং তত্ত্ব, একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্ব, আপেক্ষিকতা তত্ত্ব — এককথায় আধুনিক বিজ্ঞানের সমস্ত ভাবনার মূল ধারণা লিপিবদ্ধ রয়েছে!’

আধুনিক ভারতের অন্যতম বিশিষ্ট বিজ্ঞানী পুষ্প ভার্গব। হায়দরাবাদের ‘সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি’-র তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা অধিকর্তা। ওরিয়েন্ট লংম্যান থেকে ২০০৩ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা একটি বইয়ে আমরা দেখতে পাই তিনি লিখছেন, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বহু বিষয়ে আমাদের সাফল্য রয়েছে। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, মেডিসিন, শল্যবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, সুগন্ধিবিদ্যা-র নাম অবশ্যই করা যায়। কিন্তু অসংখ্য পৌরাণিক আখ্যান আজও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সিংহভাগ আখ্যানের কোনো যুক্তি ও সারবত্তা নেই। অথচ শুধুমাত্র বিশাল সংখ্যক সাধারণ নাগরিক নন, বিজ্ঞানীদেরও কেউ কেউ এমন বার্তা বহন করে চলেছেন।’

সিদ্ধিদাতা গণেশের দুগ্ধ পানের আখ্যান বহু বছর আগে সারা দেশে ছড়িয়েছিল। এখন তিনি আবার দৃশ্যপটে। গণেশের গজমস্তক নিশ্চয়ই প্লাস্টিক সার্জারির ফসল। এমনটাই দাবি করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভূতপূর্ব প্রধান ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক যশপাল তার সমালোচনা করেছেন। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে মিথের জগতে বিজ্ঞানের অকারণ উপস্থিতি মানতে বারণ করেছেন। ড. নরেন্দ্র দাভোলকারের জীবননাশ, সুদর্শন রাওয়ের ইতিহাস চর্চার প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে অধিষ্ঠান, সিদ্ধিদাতা গণেশের মস্তক নিরীক্ষণে অত্যাধুনিক শল্য চিকিৎসার উপস্থিতি ঘোষণা — একটি আখ্যানও কোনো‍‌ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়

একবিংশ শতাব্দীতে তথাকথিত ‘ঈশ্বরকণা’-র ঈশ্বরত্বের সংস্পর্শ দূর করতে বিবৃতি দিচ্ছেন বিজ্ঞানী পিটার হিগ্‌স, আর আমরা সবাইকে অন্ধকার গহ্বরের দিকে নিয়ে চলেছি। নিয়ে চলেছি কোন্‌ ভারতের সন্ধানে? অনতিবিলম্বে যদি প্রতিবাদ ধ্বনিত না হয়, ভাবী প্রজন্মের সর্বনাশের হাত থেকে নিস্তারের কোনো আশা নেই। আমরা তাই আসুন, সম্মিলিত প্রতিবাদে যোগ দিই।


Prof_Shyamal_Chakrabarti(লেখক কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)

Tags: , , , , , , ,

One Response to “Road to Destruction”

  1. Ashok Kumar Chaudhury Says:

    We should read the above article and tell others to go through the article.

Leave a comment