Capitalism is the Root Cause of All Ills

 

পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই হলো আসল অপরাধী

সীতারাম ইয়েচুরি

sitaram_yechury

    প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং গত শনিবার ভারতীয় শিল্প জগতের পরামর্শদাতা ও পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং শিল্পবিকাশের দ্রুত হ্রাসমান হার।। দু’টি বিষয়ই উদ্বেগ ও আশঙ্কার, সন্দেহ নেই।

    ঐ বৈঠক যখন চলছিল তখন অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ উত্তাল হয়ে উঠেছেন ওয়াল স্ট্রিট বিরোধী আন্দোলনে। যা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের ১৫০০টিরও বেশি শহরে। ২০০৮ সালে ওয়াল স্ট্রিটের ৫টি বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান (বিগ ফাইভ) মন্দার কবলে পড়ে। তারপর থেকে সাধারণ মানুষ আরো বেশি শোষণ ও বঞ্চনার মুখে পড়েন। ফলে তাঁদের ক্ষোভ ক্রমশ অগ্নিগর্ভ হ‍‌য়ে ওঠে। এখন যার অগ্নুৎপাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ক্ষোভের মাত্রা এখন সহ‍‌জেই টের পাওয়া যাচ্ছে। ঐ অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বেকারীর হার নজিরবিহীনভাবে বেড়ে গেছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে সামনে চলে এসেছে কোম্পানিগুলির উদগ্র মুনাফা লালসা। সাধারণ মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, এই অবাধে মুনাফা মৃগয়ার জন্যই তাঁদের আজ এই দুরবস্থা।

    তাই যখন বাতাসে আন্দোলিত অসংখ্য ব্যানারে আহ্বান জানানো হয় শ্রেণীযুদ্ধের, তখন আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ থাকে না। এখানে উল্লেখ করা যায়, বিশ্ব মন্দা শুরু হওয়ার পর থেকে কাল মার্কসের ‘দাস ক্যাপিটাল’-র বিক্রি বেড়ে গেছে।

    ‘দাস ক্যাপিটাল’-র প্রথম খণ্ডের শেষ অধ্যায়টি আরেকবার পড়ে নেওয়া যেতে পারে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘‘মুনাফা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত। সমস্ত রক্ত ও ক্লেদ নিয়ে যা সমস্ত ছিদ্র দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে।’’ মার্কস তাঁর বক্তব্যকে জোরালা করার জন্য ফুটনোটে একজন শ্রমিক টি জে ক্যানিংকে উদ্ধৃত করেছেন : যদি উপযুক্ত পরিমাণে মুনাফা হয় তাহলে পুঁজি খুব সাহসী হয়ে ওঠে। যদি মুনাফার হার ১০ শতাংশে দাঁড়ায় তাহলে পুঁজির সর্বত্র বিনিয়োগ সুনিশ্চিত হয়। ২০ শতাংশ মুনাফা আগ্রহ সৃষ্টি করে। ৫০ শতাংশ মুনাফায় তৈরি হয় ইতিবাচক ঔদ্ধত্য। ১০০ শতাংশ মুনাফায় পুঁজি সমস্ত মানবিক আইনকে পদদলিত করার জন্য তৈরি হয়। ৩০০ শতাংশ মুনাফায় পুঁজি এতটাই উন্মত্ত হয়ে উঠবে যে, সে যে কোনো রকম অপরাধ করতে পেছুপা হবে না। যে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেবে, এমনকি মালিকের ফাঁসির আশঙ্কা থাকলেও সে পরোয়া করবে না।’’ যে-কোনো মূল্যে সর্বোচ্চহারে মুনাফা করার এই অন্ত:স্থিত তাড়না হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সহজাত চরিত্র। বর্তমান সঙ্কটের মূলে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত লোভ বা লালসা বা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার দুর্বলতা কারণ হিসাবে কাজ করছে না।

    চূড়ান্ত মুনাফা করার উদগ্র বাসনাই হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্কটের মূল কারণ। অনেকে একে লোভের সমার্থক বলে মনে করেন। অতিকথন আছে, লোভের সঙ্গে পুঁজিবাদের সংস্রব নেই, সুতরাং লোভকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এই ধারণা আবার বুদবুদের মতো ফেটে গেল। লোভ হলো পুঁজিবাদের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। কোনো ব্যক্তি পুঁজিপতির প্রচণ্ড অর্থলিপ্সা নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই হলো আসল অপরাধী।

    সচেতনভাবেই একটি অতিকথন তৈরি করা হয়েছে। তা হলো পুঁজিবাদের আওতায় রাষ্ট্র হলো নিরীহ ধরনের নিরপেক্ষ একটি সংস্থা। কিন্তু সেই ধারণা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তার চরিত্রের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র অতিকায় লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে সঙ্কট থেকে মুক্ত করার জন্য হস্তক্ষেপ করেছিল। অথচ এরাই প্রাথমিকভাবে বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী। মার্কিন সরকারের আর্থিক সঙ্কটমোচন কর্মসূচীর স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল বলেছেন, ২০০৭ সালে আর্থিক সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে কয়েক ডজন কর্মসূচী রূপায়িত করেছে। যেগুলির লক্ষ্য ছিল দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাহায্যের এই সম্ভাব্য পরিমাণ ২৩.৭ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। এর সঙ্গে তুলনীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ, ডলারের অঙ্কে যা ১৪ লক্ষ কোটি ডলারের কিছু বেশি। মার্কিন ট্রেজারির মুখপাত্র অবশ্য এই তথ্য স্বীকার করতে চাননি।

    বড় বড় কোম্পানিগুলিকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করার জন্য একইরকমভাবে বেশ কয়েকটি শিল্পোন্নত দেশ বিপুল অঙ্কের অর্থ ঋণ করেছে। কর্পোরেট দেউলিয়ার দায় শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ ঋণের অঙ্ক সামলাতে গ্রিস, স্পেনের মতো দেশগুলি কার্যত ধুঁকছে। আরো কিছু দেশেরও এই ধরনের শোচনীয় দশা হতে পারে। এরা এখন কঠোরভাবে কৃচ্ছ্রসাধনের কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যার অর্থ হলো খেটে খাওয়া মানুষের জন্য নির্দিষ্ট জনকল্যাণ কর্মসূচী ও সরকারী বরাদ্দ মারাত্মকভাবে ছাঁটাই করা। ফলে প্রায় রোজই সেখানে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও সাধারণ ধর্মঘট হচ্ছে।

    অপরদিকে ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা ‘দেউলিয়া’ মেরিল লিঞ্চ সংস্থাকে অধিগ্রহণ করার পর ২০১১ সালের প্রথমার্ধে ৩৭০ কোটি ডলার মুনাফা করেছে। গোল্ডম্যান স্যাক্‌স তাদের এক্সিকিউটিভদের বোনাসের জন্য ৫২৩ কোটি ডলার আলাদা করে সরিয়ে রেখেছে।

    এই পটভূমিকায় নয়া-উদারনৈতিক সংস্কারের পথ অনুসরণ করে চলা ভারতীয় রাষ্ট্রও যে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে তা প্রতিফলিত হয়েছে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের আলোচনায়। সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতির হার ৯.৭২ শতাংশে দাঁড়ালেও খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে আরো বেশি হারে। অপরদিকে শিল্পোৎপাদনের সূচক নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪.১ শতাংশে। বিশ্ব মন্দার জন্য রপ্তানির পরিমাণ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৮২ থেকে কমে ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানির পরিমাণ যেভাবে কমে গেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩৫০ কোটি ডলার। যা এক কথায় নজিরবিহীন।

    বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করছেন, মুদ্রাস্ফীতি সামাল দেওয়ার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে সব ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে ঋণ নেওয়ার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং পরিণতিতে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ধারণা করা হচ্ছে, পুঁজি সংগ্রহের ব্যয় যদি কম হয় তা হলে বিনিয়োগ বাড়বে এবং তার ফলে উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এই ধারণা বাস্তবোচিত নয়। কারণ উঁচু হারে বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে যা উৎপন্ন করা হয় তা বিক্রি করার জন্য প্রয়োজন মানুষের কেনার ক্ষমতা। কিন্তু বিশ্বে এবং আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ভীষণভাবে কমে যাওয়ায় নয়া উদারনৈতিক প্রেসক্রিপশন কোনো কাজে লাগছে না। সস্তায় পাওয়া ঋণকে কাজে লাগিয়ে ফাটকা ব্যবসায় বিপুল মুনাফা করার কারসাজিকে আড়াল করার জন্য এসব কথা বলা হচ্ছে।

    চূড়ান্ত মুনাফা অর্জনের জন্য এই নির্লজ্জ অভিযানকে নিষ্ফলা করার জন্য কেইনসীয় ধাঁচে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ হলো একটি সম্ভাবনাময় পথ। তবে কেইনসবাদে জনগণকে রিলিফ দেওয়ার বদলে রয়েছে কাঠামোগত এমন এক বিন্যাস যার উদ্দেশ্য হলো বারংবার সঙ্কটে নিমজ্জিত হওয়ার হাত থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে রক্ষা করে স্থিতিশীল রক্ষা করা। এইভাবে সঙ্কটে নিমজ্জিত হওয়ার ঝোঁক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্ন্তনিহিতভাবে আছে।

    নয়া-উদারনৈতিক ব্যবস্থায় অবশ্য রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ করা হয় সঙ্কটাপন্ন কোম্পানিগুলিকে বাঁচানোর জন্য। অবশ্য সেই ভরতুকি শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হয়। ফলে এই ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা আরো নষ্ট হয়।

    ভারতীয় পটভূমিকায় আমাদের অর্থনীতির বুনিয়াদকে শক্তিশালী করার জন্য সরকারী হস্তক্ষেপ এমনভাবে করতে হবে যাতে আমাদের দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা প্রসারিত হয়। তাহলে মোট অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বিস্তৃত হবে। ফলে স্থায়ী ধরনের বিকাশের পথ প্রশস্ত হবে।

    গত দু’বারের কেন্দ্রীয় বাজেটের নথিপত্রে দেখা গেছে, বড়লোকদের কর ছাড় বাবদ সরকারের ৫ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরামর্শদাতাদের উচিত, এই ধরনের ধারা ভালো করে খতিয়ে দেখা এবং এই ধারাকে পালটানো। এই অর্থ প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো অর্থাৎ রাস্তাঘাট, সড়ক ইত্যাদি তৈরির জন্য কাজে লাগালে কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে বাড়ানো যেত। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও বিপুলভাবে বাড়তো।

    এখনও পথ বেছে নেওয়ার সময় আছে। সাধারণ মানুষের প্রবল চাপের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারকে ঐ পথ বেছে নিতে বাধ্য করতে হবে।

Tags: , , , ,

Leave a comment