Posts Tagged ‘tushar kanjilal’

“If I Were Mother Of A Worthless Son”

October 11, 2014

আমি বা আমরা কথা রাখিনি

তুষার কাঞ্জিলাল

সমসাময়িক এক কবিবন্ধু লিখেছিলেন, ‘কেউ কথা রাখেনি’৷‌ আজ বার্ধক্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে কে বা কারা কথা রাখেনি, সে হিসাব করার কোনও উৎসাহ পাই না৷‌ মনে হয়, প্রাক‍্-জন্মকাল থেকে এ তাবৎ যাকে যত কথা দিয়েছিলাম, তার অনেকটাই রাখিনি৷‌ মনে হয় আর যে ক’বছর আয়ু আছে, ব্যক্তি বা সমাজ তাদের সবার কাছে এই না দিতে পারার অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার অবসরটুকু হয়ত আর বাকি আছে৷‌

প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ হয়ে জন্মাবার আগে হয়ত-বা অনুচ্চারিত শব্দে কথা দিয়েছিলাম যে, আজন্মকাল প্রকৃতির সঙ্গে তারই অংশ হিসাবে বাঁচব এবং প্রতি মুহূর্তে তার ঋণ শোধ করব৷‌ এই বিশাল বিপুল সৃষ্টির যত বৈচিত্র্য এবং সম্পদ, তাকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপাত করব৷‌ আকাশ বাতাস, পাহাড় পর্বত, নদী সমুদ্র মরুভূমি রক্ষার ক্ষেত্রে সীমিত জীবনে আরও সীমিত ক্ষমতায় নিজেকে নিবেদন করতে কার্পণ্য করব না৷‌ সে কথা রাখিনি৷‌ রাখতে পারিনি৷‌ রাখতে তো পারিইনি সারাজীবন, প্রতিটি কর্ম এবং চিম্তায় তার উল্টোটাই বোধহয় বেশি করেছি৷‌ জন্মের পর বুদ্ধির উন্মেষের দিন থেকে কথা দিয়েছিলাম যে, প্রকৃতির ঈপ্সিত এমন একটা সমাজ গড়ে তুলব, যে সমাজ প্রতিটি জন্মিতকে এমন ধরনের একটা সামাজিক অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশে আবাহন জানাবে, যাতে সে তার মধ্যে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত যা কিছু মহৎ তার পুরোপুরি বিকাশ ঘটাতে পারে৷‌

আজ মনে হয় সে কথা তো রাখিইনি, তার বদলে এমন একটা সমাজ গড়ে তুলেছি, যেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো নির্মল বাতাস পাবে না, পান করার মতো তাদের জন্য রেখে যেতে পারব না বিশুদ্ধ পানীয় জলটুকুও৷‌ প্রকৃতিকে দূষিত করে এমন বিষময় করে রেখে যাচ্ছি, মাতৃগর্ভে যে শিশুটি ভবিষ্যতের মায়েরা গর্ভে ধারণ করবেন, তাঁদের আশীর্বাদ করতে গেলে বোধহয় বলতে হবে যে, তোমার সম্তানটি যেন বিকলাঙ্গ হয়ে না জন্মায়৷‌ প্রকৃতির ইচ্ছায় একক নয়, একজন সামাজিক মানুষ হিসেবেই আমার পরিচিতি৷‌ সুস্হ সুন্দর সামাজিক একটা জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করে ভালবাসা মমতা প্রীতি এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা৷‌ বহুর মধ্যেই আমার একক অস্তিত্বকে সার্থক করে তোলা সম্ভব৷‌

পরিবার থেকে শুরু করে বিশ্বমানব জাতির একজন হিসেবে কথা দিয়েছিলাম ভালবাসব। ঘৃণা হিংসা নীচতা এগুলিকে প্রশ্রয় দিয়ে সমাজকে পারস্পরিক মারামারির উর্বর ভূমি করে তুলব না। সে কথা রাখতে পারিনি শুধু তাই নয়, যা কিছু শুভ মঙ্গলময় আনন্দের আধার, তাতে প্রভাবিত না হয়ে গোটা দুনিয়া জুড়ে দেশে দেশে নিত্য দ্বন্দ্ব, জাতপাত ধর্মের নামে পারস্পরিক হানাহানি– মানুষের এ পৃথিবীটাকে দানবের পৃথিবী করে রেখে যাচ্ছি৷‌ আরও হয়ত অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে নিজেকে দেওয়া কথা, সমাজকে দেওয়া কথা, বিশ্ব মানব জাতিকে দেওয়া কথার কোনওটাই রাখিনি৷‌

আজ যে এসব কথা হঠাৎ ভীষণ করে নাড়া দিয়ে গেল, তার কারণ হিসেবে দুটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বলাটা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না৷‌

বদর শেখ সুন্দরবনের অতি প্রত্যম্ত একটি গ্রামে অতি দরিদ্র হা-ভাতে একটি ঘরে জন্ম নিয়েছিল৷‌ পিতা ছিলেন অনিচ্ছুক জন্মদাতা এবং মা ছিলেন অনিচ্ছুক জন্মদাত্রী৷‌ মানুষ বিধাতা এবং প্রকৃতির দান হিসেবে একটা পুরো মানুষ হয়েও তার জন্ম হয়নি, কারণ সে জন্ম থেকেই বিকলাঙ্গ৷‌ কোমর থেকে পা দুটো দেহের ঊধর্বাংশের তুলনায় অনেকটাই সরু৷‌ মায়ের কোলও তাকে বেশিদিন আশ্রয় দিতে পারেনি৷‌ যখন বছর তিনেক বয়স, তখন মা নবম সম্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ইহলোক ছেড়েছেন৷‌ বাবা একটু শক্ত-সমর্থ ছিলেন, তাই ষাটোধর্ব বয়সেও তাদের একজন নতুন মা এনে দিতে বেশি দেরি করেননি৷‌ তার ফলে অবহেলা, লাঞ্ছনা, অনাহার, অপুষ্টি এসবের সঙ্গে লড়াই করে ও বেঁচে থেকেছে৷‌ ও বিশ্বাস করেছিল প্রকৃতি যখন মানুষ সৃষ্টি করেন, তার বেঁচে থাকার রসদগুলি দিয়ে তিনি নিজেকে ভরে দেন৷‌ তাই মাটি ছিল তার মা৷‌ চারদিকের পশুপাখি গাছপালা হাওয়া বাতাস– এ সবকে সম্বল করেই সে মরতে মরতে বেঁচে ছিল৷‌

বদরকে আমি চিনতাম তার কৈশোর থেকে৷‌ তার সহোদরা দুই দিদি একটু বয়স হওয়ার পরই বীজ বোনা থেকে ফসল কাটা পর্যম্ত মাঠে মজুরি খেটে, তারপর সন্ধ্যার পর থেকে সম্পন্ন গৃহস্হের বাড়িতে ঢেঁকিতে ধান কুটে, নিজেদের এবং এই পঙ্গু অক্ষম ভাইটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল৷‌ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহের আকৃতিগত পরিবর্তন প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটতে থাকে৷‌ বদর কিশোর থেকে ক্রমে যুবক হয়৷‌ হাত দুটোর ওপর ভর করে সে কৈশোরেই চলা শুরু করে৷‌ যৌবনে তাকে দেখতাম, এই ভাবেই গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে নদীঘাটে পৌঁছচ্ছে, দু-চারজনের সহায়তায় নদী পেরিয়ে ওপারের গ্রামে স্বচ্ছন্দ বিচরণ করে পেটের ভাত জোগাড়ের চেষ্টা করছে৷‌ শুধু দুটি অন্ন খুঁটে খেয়ে যে মানুষ বাঁচতে পারে ও বাড়তে পারে, এত কাছ থেকে এমন ভাবে আর কাউকে দেখার সুযোগ পাইনি৷‌ মাঝে মাঝেই আমার কাছে আসত৷‌ একদিন কথায় কথায় বলছিল যে, ‘বাবু আমার জীবনে দুটো বাসনা। আমার দিদিদের দুই দানবের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে৷‌ সারা দিনরাত অক্লাম্ত খাটতে হয়। তারপরে দুটি করে কন্যাসম্তানের জন্ম দেওয়ায় প্রচণ্ড পেটান খেতে হয়৷‌ আমার ভীষণ ইচ্ছে, ওদের আমার কাছে এনে রাখব৷‌ আর বুড়ো বাবা সৎ মায়ের অত্যাচারে এই বয়সেও শরীরে নানা অসুখ নিয়ে রোজ খাটতে বেরোন৷‌ মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যান, লোকজন বাড়িতে পৌঁছে দেয়৷‌ একটু তেষ্টার জলও সব সময় পান না৷‌ তাই আমার ভীষণ ইচ্ছে, বাবাকেও আমার কাছে এনে মরার যে কটা দিন বাকি আছে, রাখি৷‌ ও নিজে এই কথাগুলি দিয়েছিল এবং আমৃত্যু সেই কথা রেখেছিল৷‌ সে ইতিহাস বলতে গেলে দশকাহন হয়ে যাবে৷‌

ওর মৃত্যুর দিনটা আমার ভীষণ মনে পড়ে৷‌ এই শরীরে ও বোনেদের এবং একটি ভাগ্নের সাহায্য নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে সরকারি খাস জমিতে একটি বাস্তু বানিয়ে ছিল৷‌ চাষের জমি ছিল না, একটি ছোট পুকুর আর বাস্তু বাদে কাঠা পাঁচেক জমি আর ঘরের বাড়ির সামনে একটি ছোট মুদিখানার দোকান৷‌ দোকানে ওই বসত আর সারাদিন বিড়ি বাঁধত৷‌ রাতে বোনেদের দিয়ে কাগজের ঠোঙা বানাত৷‌ বাবাকেও এনে দু-তিন বছর রেখেছিল৷‌ গরিবের ঘরে রোগে শোকে যেমন ডাক্তার বদ্যি দেখানো হয়, সেটুকু এবং ভাল খাবার-দাবারের জোগাড় ও করতে পেরেছিল৷‌ ওর বাড়িটা ছিল মাটির দোতলা বাড়ি৷‌ তলায় মাটির মেঝেতে বাবা আর ছেলে ঝ্যাতলা পেতে শুয়ে থাকত৷‌ আমার সঙ্গে তার একটা অসম বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল৷‌ আমি তাকে ভালবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম অল্পসল্প সাহায্যও হয়ত কখনও কিছু করেছি৷‌ একদিন গভীর রাতে হইচই চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলে দৌড়ে গিয়ে শুনলাম, বদরকে মাটি ফুঁড়ে কালাজ সাপে কেটেছে৷‌ এ সাপের কামড়ে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী৷‌ আমি যখন পৌঁছই, তখন ওর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে৷‌ কথা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে৷‌ শুধু দুটি কথা আমাকে বলেছিল, ‘বাবু আমার বোনেদের আর বুড়ো বাপটাকে একটু দেখবেন৷‌’ বদরের মৃত্যু একটা মহান মানুষের মৃত্যু৷‌ তার মৃত্যু একটা পবিত্র আত্মার মুক্তি৷‌ বদর তার কথা রেখেছিল৷‌ আজ এই বৃদ্ধ বয়সে কথা রাখতে পারিনি বলে নিজেকে অভিশাপ দিই৷‌

দ্বিতীয় প্রেক্ষিতটা শহরের৷‌ কুলভূষণ আমার স্কুলজীবনের বন্ধু৷‌ দরিদ্র পরিবারের সম্তান৷‌ তাদের পারিবারিক পেশা ছিল সোনা-রুপোর গয়না তৈরি করা৷‌ কুলভূষণ অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিল৷‌ হাতের লেখা ছিল মুক্তাক্ষর৷‌ অবিভক্ত বাংলায় ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিল৷‌ তারপরে অনেক দিন যোগাযোগ নেই৷‌ আশির দশকে হঠাৎ বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারদের একটি সম্মেলনে গিয়ে কুলভূষণের সঙ্গে আবার দেখা৷‌ সে তখন গোটা দেশের বাস্তুকারদের মধ্যে যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছে৷‌ সল্টলেকে একটা প্রাসাদোপম বাড়ি করেছে৷‌ দুই পুত্র এবং এক কন্যাসম্তানের পিতা৷‌ একটাই সমস্যা, স্ত্রী মধ্যবয়স থেকেই রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের শিকার৷‌ নিজে কোনও কাজই করতে পারেন না, এমনকি ঘরের মধ্যেও চলাফেরা করতে অসমর্থ৷‌

কুলভূষণ অধুনাকালের বিচারে তিনটি সম্তানকেই মানুষ করে গড়ে তুলেছিল৷‌ সেই ছেলেদের বিয়ে-থা হয়ে গেছে৷‌ মেয়েরও খুব ভাল একটা জায়গায় বিয়ে দিয়েছে৷‌ কিন্তু তাদের দুজন আমেরিকা প্রবাসী, অপরজন অস্ট্রেলিয়ার স্হায়ী বাসিন্দা৷‌ ছেলেরা বছরে দু বছরে একবার দেশে আসে এবং প্রথমে কয়েক দিন শ্বশুরালয়ে কাটিয়ে সন্তান-সন্ততিদের ভারতে দর্শনীয় স্হানগুলি ঘুরিয়ে, ফিরে যাওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে বাপ-মাকে দেখতে আসে৷‌ মেয়েটি একজন অস্ট্রেলিয়ান যুবককে বিয়ে করেছে৷‌ সে এদেশে আসার কোনও উৎসাহ পায় না, তাই মেয়েটিরও আসা হয়ে ওঠে না৷‌ আমার সঙ্গে যোগাযোগটা ছিল, কিন্তু আমি বনবাসে যাওয়ার পর সেটা অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল৷‌ একবার এসে খবর পেলাম, কুলভূষণ হঠাৎ হৃদরোগে আক্রাম্ত হয়ে মারা গেছে৷‌ প্রাসাদোপম বাড়িতে অথর্ব এবং চিররুগ‍্ণ স্ত্রী একা থাকেন৷‌ চুরি-ডাকাতি করে সর্বস্ব নিয়ে যাবে, সেই ভয়ে সে সারাক্ষণের কাজের লোকও রাখে না৷‌ আমি কলকাতা এলেই দেখা করতে যেতাম৷‌ কথায় কথায় একদিন ওর স্ত্রী বলছিলেন যে, একটা ছেলেকেও যদি অমানুষ করতাম আর পাড়ায় একটা মুদিখানার দোকান খুলে দিতাম, তাহলে বোধহয় এই অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সেই ছেলেটি কথা রাখত৷‌

মাতাপিতারা ছেলেমেয়েদের মানুষ করে তোলার প্রাণাম্তকর চেষ্টায় প্রতিযোগিতার বাজারে আত্মসর্বস্ব, সম্পূর্ণ ব্যক্তিকন্দ্রিক, চরম লোভী এবং অপরিমিত ভোগ-আকাঙ্খার দাস ক’রে ‘সফল’ মানুষ হিসাবে জীবন গড়তে গিয়ে কখনও অপরকে এমনকি নিজের পিতামাতাকেও কোনও কথা দেওয়ার কথা ভাবারও সময় দেয়নি৷‌ তাই আজ গর্ভধারিণী, জন্মের জন্য যার কাছে ঋণী, জন্মকাল থেকে তার স্নেহ মমতা এবং মঙ্গল কামনার ঘেরাটোপে আশ্রিত থেকে, সব ধরনের চাহিদার অপর্যাপ্ত জোগানদার বাবা-মাকে কোনও কথা দেওয়ার দায় ছিল না৷‌ তাই সব কথা রাখার দায় নিয়েও কেউ ভাবে না৷‌ পরিবার-সমাজ-নিরপেক্ষ ভোগজ্বরে আক্রাম্ত একটা অস্তিত্ব৷‌ মৃত্যু পথযাত্রী চরম দৈহিক যন্ত্রণার শিকার। স্নেহ মমতা শ্রদ্ধা ভালবাসা পাওয়ার প্রবল আকুতি নিয়ে, দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে বেঁচে শুধু দিন যাপনের, প্রাণ ধারণের গ্লানি নিয়ে মরণের অপেক্ষা৷‌

ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই, পুনর্জন্মে যেন বদরের মতো একজন অপদার্থের মা হওয়ার সৌভাগ্য তার হয়৷‌


Tushar_Kanjilal_73yrs_1Tushar Kanjilal is an octogenarian social activist based at Rangabelia, The Sunderbans, S. 24-Parganas, WB, India. He is associated with ‘Tagore Society for Rural Development’.

Dr. Pashupatinath Chatterjee

February 8, 2014

ডাঃ পশুপতিনাথ চ্যাটার্জি

তুষার কাঞ্জিলাল

জীবনে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে যাঁদের আত্মীয় বলে ভেবে নিতে বেশিদিন সময় লাগে না৷‌ নিজগুণে তাঁরা অন্যের মনের অনেক কাছাকাছি চলে আসতে পারেন৷‌ কিছু মাত্র চেষ্টা না করে তাঁরা মানুষের শ্রদ্ধা, অকুন্ঠ প্রীতি অতি সহজেই আদায় করে নেন৷‌ এমনই একজন মানুষ ডাঃ পশুপতিনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিতি এবং দীর্ঘকাল কাছাকাছি থাকার সুযোগ ঘটেছে৷‌ তাঁর প্রীতি এবং স্নেহধন্য ছিলাম এটা ভাবলে গর্ব হয়৷‌টেগোর সোসাইটি যার আমি বর্তমান সম্পাদক, তিনি দীর্ঘকাল তার সভাপতি ছিলেন৷‌ আমাদের মুখপত্র কম্পাস পত্রিকারও তিনি ছিলেন প্রধান সম্পাদক৷‌ লেজুড়ের মতো সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে আমার নাম থাকলেও সব দায়িত্ব উনি নিজেই বহন করতেন৷‌ তাঁর গত ২৭ তারিখে দেহাবসান ঘটেছে৷‌ পরিণত বয়সেই মৃত্যু কিন্তু আমাদের মতো অনেকেই চরম বেদনাহত৷‌ পৃথিবী থেকে অতি পবিত্র একটি মানুষ চিরতরে বিদায় নিলেন৷‌
কোনও কোনও মৃত্যু পৃথিবীকে দরিদ্র করে৷‌ তাঁর ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে৷‌ পেশায় ছিলেন খ্যাতনামা শল্যচিকিত্সক, দেশ থেকে ডাক্তারি পাস করে তিনি চীনে চলে যান৷‌ সেখানে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্হার সঙ্গে কয়েক বছর চিকিত্সক হিসেবে থেকে তারপর বিলেতে চলে যান৷‌ ওখান থেকে এফ আর সি এস করে দেশে ফিরে অন্য দু-একটি সংস্হার সঙ্গে কাজ করেন এবং শেষে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন৷‌ কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনা সূত্রে যুক্ত থাকাকালীন তাঁর ব্যক্তিত্ব, কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং রোগীদের প্রতি সহমর্মিতা তাঁর অনেক ছাত্রকে প্রভাবিত করেছিল৷‌
টেগোর সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর দেখেছিলাম প্রয়াত পান্নালাল দাশগুপ্ত তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং অনেক ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্ভর করতেন৷‌ তাঁর জীবনের মূল্যবোধগুলির সঙ্গে তিনি কখনও compromise করতেন না৷‌ অত্যম্ত দক্ষ শল্যচিকিত্সক হওয়া সত্ত্বেও অর্থোপার্জনের দিকে তিনি অনেকটা নির্মোহ ছিলেন৷‌ তাঁর মাপের সমসাময়িক চিকিত্সকরা যে পরিমাণ অর্থোপার্জন করেছেন, তিনি তার ধারেকাছেও যান না৷‌ এটা নয় যে তাঁর রোগীর সংখ্যাল্পতা ছিল৷‌ প্রচুর রোগী ছিল, কিন্তু অর্থাভাবের কথা বললে সে রোগীর কাছ থেকে তিনি টাকা নিতেন না৷‌ এমনকি এমনও দেখেছি যে অপারেশনের পর রোগী সুস্হ হওয়া পর্যম্ত ওষুধের খরচা তিনি নিজেই দিতেন৷‌আমি তখন সুন্দরবনে থাকি, অনেক চেষ্টাচরিত্র করে একটা ছোট হাসপাতাল গড়ে তোলা গিয়েছিল৷‌ তার সঙ্গে রাঙ্গাবেলিয়ার নিকটবর্তী দ্বীপগুলিতে কিছু স্বাস্হ্য পরিষেবা পৌঁছবার চেষ্টা চলছিল৷‌ ডাঃ চ্যাটার্জি তখন অবসর নিয়েছেন৷‌ আমাদের এই চেষ্টায় সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার জন্য তিনি প্রায় একশত বারেরও বেশিবার রাঙ্গাবেলিয়ায় গিয়েছেন৷‌ কলকাতায় তাঁর প্র্যাকটিসের আয় ছেড়ে দিয়ে প্রয়োজনে তিন-চারদিন থেকেছেন এবং কয়েকশো রোগীর অপারেশন করেছেন৷‌ বোকার মতো প্রথমবার তাঁকে কিছু অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তিনি বলেছিলেন, তাহলে তিনি রাঙ্গাবেলিয়া আসাই বন্ধ করে দেবেন৷‌ বলেছিলেন, ওই হতদরিদ্র মানুষগুলির কাছ থেকে পয়সা নিলে তার বদলে যা খোয়াতে হবে, তা হচ্ছে মানবিকতাবোধ এবং মনের শাম্তি৷‌

প্রায়ই বলতেন যে তাঁর পরিবারের আর্থিক চাহিদা খুবই সামান্য৷‌ বহুকষ্টে সল্টলেকে একটা বাড়ি করেছিলেন এবং দুটি পুত্রসম্তানের পিতা ছিলেন৷‌ ছেলেদের লেখাপড়ার ব্যাপারে এলাহি কাণ্ডকারখানা কিছু করেননি৷‌ ছেলে দুটি এখন প্রতিষ্ঠিত৷‌ এদের লেখাপড়ার খরচাটা তাঁকে রোজগার করতে হত৷‌ উনি বলতেন যে, সেটা রোজগার করতে এবং মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করতে যে অর্থের প্রয়োজন সেটা রোজগার করতে খুব চেষ্টা করতে হয় না৷‌ বাকি সময়টা কীভাবে ব্যয় করবেন তার একটা নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল৷‌ তিনি বলতেন যে, ডাক্তারি পাস করতে তাঁর পেছনে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে, তার অনেকটাই বহন করেছে সরকার এবং সমাজ৷‌ একটা হিসেব বের করেছিলেন যে, তিনি ডাক্তার হতে গিয়ে একজন শ্রমজীবী মানুষের ৩৪ বছরের আয় ভোগ করেছেন৷‌ তাই এঁদের ঋণ ফিরিয়ে দেওয়ার দায়টা সারাজীবন বয়ে যেতে হবে৷‌ পারিবারিক বৃত্তের বাইরেও যে বৃহত্তর সমাজ, তার কাছে তিনি দায়বদ্ধ, এটা জীবনের অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে একটি৷‌

প্রসঙ্গত দুটি ঘটনার কথা বলে আমার কথা শেষ করব৷‌ সেটা ব্যক্তিগত ঋণ, যা স্বীকার না করলে পাপ হবে৷‌ তখন সুন্দরবনে আমার বাস, হঠাত্ ডাক্তারবাবু বললেন, আমার স্ত্রীর একটা অপারেশন করা অত্যম্ত জরুরি৷‌ তখন কলকাতায় আমার কোনও স্হায়ী ঠিকানা ছিল না৷‌ ডাক্তারবাবু সেটা জানতেন৷‌ তিনি আমার গোটা পরিবারকে কলকাতায় এনে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিলেন৷‌ সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজেই অপারেশন করে আমার স্ত্রীকে সুস্হ করে তুললেন৷‌ গোটা দায়িত্বটাই তাঁর৷‌ কোনও ধরনের সাহায্য লাগতে পারে কিনা জিজ্ঞেস করায় উত্তর পেয়েছিলাম, এটা আমার নয়, ওনার দায়৷‌ বীণাদেবী সুন্দরবনে বসে যে কাজটা করছেন তাঁকে সুস্হ রাখায় দায় আমাদের৷‌ আমি বেশি কিছু করছি না৷‌

তাঁর জীবনের আর একটা দিক ছিল আগ্রহী পাঠকের৷‌ শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন৷‌ পৃথিবীর সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের জগতে নতুন কী ভাবা হচ্ছে এবং তা আমাদের ক্ষেত্রে কতটা কাজে লাগতে পারে প্রায়ই এসে সে-সব বিষয় আলোচনা করতেন৷‌ অনেক সময় সদ্য প্রকাশিত অনেক বইয়ের খবর তাঁর কাছ থেকে পেতাম৷‌ প্রকৃত অর্থে তিনি সব সময়ই আধুনিক৷‌ কোনও মালিন্য তাঁকে স্পর্শ করত না৷‌ কোনওদিন তাঁকে কারও বিরুদ্ধে কিছু বলতে শুনিনি৷‌ সংগঠনের কাজে যখন যা চেয়েছি সেই সাহায্য পেয়েছি৷‌ ডাঃ চ্যাটার্জির মৃত্যুর পর বারবার মনে হচ্ছে যে এই ধরনের অতি উচ্চমাপের মানুষগুলি বিলুপ্ত প্রজাতি হয়ে যাচ্ছে৷‌ এ ধরনের মানুষ কোনও প্রচারের আশা না নিয়ে নিজের জীবনকে বহুর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়ে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করেছেন৷‌ এ জাতের মানুষ আজকের সমাজে বিরল৷‌ কিন্তু এঁদেরই বোধহয় সমাজে আজ সবচেয়ে বেশি দরকার৷‌