বর্তমান জি এস টি ব্যবস্থার সংশোধন জরুরি
দেশে চালু হয়েছে পণ্য ও পরিষেবা কর বা জি এস টি। জি এস টি-র উৎস কি? জি এস টি-র কাঠামো কেমন? জি এস টি-র ফলে দাম বাড়ছে কোন কোন পণ্যের এই জি এস টি ব্যবস্থা কোন শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করছে? এসবেরই বিশ্লেষণ করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। পণ্য ও পরিষেবা কর (ইংরেজিতে Goods and Services Tax, সংক্ষেপে G S T, বাংলায় জি এস টি)—এই বিষয়ে আমাদের বক্তব্য চারটি অংশে ভাগ করে পেশ করব। প্রথমেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক : জি এস টি-র বিষয়টি এল কি করে? এর পরিপ্রেক্ষিতটা কি? এই পরিপ্রেক্ষিতটি ব্যাখ্যা করেই শুরু করা হবে প্রথম অংশের আলোচনা। পরিপ্রেক্ষিত সামনে রেখে জি এস টি-র কাঠামো, যা রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তুত করেছিল, তার বিশ্লেষণ থাকবে দ্বিতীয় অংশের আলোচনায়। কিন্তু বর্তমানে সর্বভারতীয় স্তর থেকে যে কাঠামো অনুসরণ করার চেষ্টা চলেছে, তা কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের প্রস্তুত করা কাঠামোর থেকে ভিন্ন। এর ফলে বর্তমানে এই কাঠামো অনুসরণ করার কারণে এই সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে বর্তমান কাঠামোর এই ক্ষেত্রগুলিতে সংশোধন করা জরুরি। তা না হলে সাধারণ মানুষের এবং রাজ্যগুলির ব্যাপকভাবে ক্ষতি হবে বিশেষ করে তীব্রতর মূল্যবৃদ্ধি এবং রাজ্যের স্বাধিকার হরণের মাধ্যমে। এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়েছে তৃতীয় অংশের আলোচনায়। এছাড়া, জি এস টি ব্যবস্থাকে একটি বিশেষভাবে ব্যবহার করা সম্ভব যা কালো টাকা উদ্ধারের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে, যে বিষয়টি বর্তমান অবস্থায় উপেক্ষিত থেকেছে শ্রেণি স্বার্থের কারণে। এই প্রসঙ্গের আলোচনা থাকবে চতুর্থ অংশে।
১. পরিপ্রেক্ষিত
জি এস টি লাগু করার সময়ে বলা হয়েছে, এরফলে কর ব্যবস্থার আরও উন্নতি হবে। কর ব্যবস্থার উন্নতি, এর মানে কি? এর মানে কর ব্যবস্থায় এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যার ফলে সাধারণ কৃষক, শিল্পোদ্যোগী এবং ব্যবসায়ী প্রত্যেকেরই করের বোঝা লাঘব হবে, এবং এর ফলে সম্ভাবনা থাকবে মূল্য হ্রাসের, যাতে উপকৃত হতে পারেন সাধারণ ক্রেতারাও। এছাড়া, একই সঙ্গে অর্জন করতে হবে কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলিতে কর রাজস্বের বৃদ্ধি, এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে সুরক্ষিত থাকে রাজ্যগুলির স্বাধিকারের বিষয়টিও।
কর ব্যবস্থার উন্নতির এই সমগ্র বিষয়গুলির আলোচনার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভার কথা (১৬ই নভেম্বর, ১৯৯৯), যা আহ্বান করেছিলেন তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শ্রীযশোবন্ত সিন্হা এবং উপস্থিত ছিলেন শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসু। ওই সভা চলাকালীন যশোবন্ত সিন্হা মঞ্চ থেকে নেমে এসে জ্যোতি বসুর সঙ্গে আলোচনা করেন। ওই সভাতে সিদ্ধান্ত হয়, কর ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে রাজ্যগুলির অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হবে। পরে ২০০০ সালে স্থির হয়, এই কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও মনোনীত কমিটি হবে না। এই কমিটি হবে নথিভুক্ত সংস্থার আইনে গঠিত রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি, এবং এই কমিটি দু’বছরের জন্য রাজ্যের একজন অর্থমন্ত্রীকে সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত করবে। এই পদে পাঁচ বার পুনর্নির্বাচিত হয়ে প্রায় দশ বছর (২০০০-০১ থেকে ২০১০-১১) আমাদের কাজ করার সুযোগ হয়।
এই কাজ করতে গিয়ে প্রথমেই আমরা লক্ষ্য করি, প্রত্যেকটি রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয় স্তরেও, সেই সময় কর ব্যবস্থার মধ্যে করের ওপর কর চাপানোর ফলে করের একটি বাড়তি বোঝা সৃষ্টি হয়ে আছে। করের ওপর কর চাপানোর বিষয়টি ছিল এইরকম। কোনও একটি পণ্য উৎপাদন করার সময় যে কাঁচামাল বা উপাদান ব্যবহার করা হতো, তার ওপর প্রথমে একবার কর দিতে হতো উৎপাদকদের। তারপর এই করের বোঝা নিয়ে যখন পণ্যটি উৎপাদিত হতো, তখন সেই পণ্যটির ওপর পুনরায় কর চাপানো হতো, অর্থাৎ, করের ওপর করের বোঝা চাপত। এর ফলে, উৎপাদনের খরচ এবং পণ্যটির দামও বৃদ্ধি পেত, এবং সামগ্রিকভাবে উৎপাদক, বিক্রেতা এবং ক্রেতা সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটির পক্ষ থেকে আমরা সর্বসম্মতিক্রমে মূল্যযুক্ত কর (ইংরেজিতে Value Added Tax, বা সংক্ষেপে VAT) ব্যবস্থা লাগু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
এই ব্যবস্থার মূল বিষয় হল, পণ্যের ওপর প্রদেয় কর থেকে উপাদানের ওপর চাপানো করটি বাদ দেওয়ার সুযোগ প্রদান করা। এর ফলে পণ্যের ওপর করের বাড়তি বোঝা লাঘব হয়ে যায়। মূল্যযুক্ত কর লাগু করার এই সিদ্ধান্ত রাজ্যগুলির জন্য লাগু হয় ২০০৫-০৬ সালে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের স্তরে ২০০২-০৩ সালে। এরফলে, পূর্বে উল্লিখিত কারণে, পণ্যের ওপর করের বোঝা হ্রাস পায় এবং এর থেকে উপকৃত হন উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা, এবং কর হ্রাসের কারণে মূল্যহ্রাসের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়। এছাড়া, উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেহেতু পণ্যের ওপর প্রদেয় কর থেকে উপাদানের ওপর কর বিয়োগের সুবিধা পেতে হলে আগেকার স্তরে করটি অবশ্যই দিতে হবে এবং তার রসিদ দেখাতে হবে, তাই এই স্তরে কর ফাঁকি রোধের জন্য নজরদারি ব্যবসায়ীরা নিজেরাই নিজেদের স্বার্থে নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন এবং বৃদ্ধি পাবে কর রাজস্ব আদায়ও। বস্তুত লক্ষ্য করা গেল, রাজ্যস্তরে মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগের পাঁচ বছরে যেখানে রাজ্যগুলির বিক্রয়কর থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির গড় বার্ষিক হার ছিল ১১%, সেখানে মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরের পাঁচ বছরে কর রাজস্ব বৃদ্ধির গড় হার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২২% (এবং পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ২০১০-১১ সালে এই বৃদ্ধির হার হয় ২৫%)।
এছাড়া, রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থার ক্ষেত্রে করের হারের সংখ্যাও কমানো হবে। একটি করমুক্ত পণ্যের তালিকা (যার মধ্যে খাদ্যশস্য, জীবনদায়ী ওষুধ, নিম্ন আয়ের মানুষদের ব্যবহারের অন্যান্য আবশ্যকীয় পণ্য, এবং সোনা ও রুপার জন্য বিশেষ করের হার (১%) ছাড়া থাকবে কেবলমাত্র দুটি করের হার—একটি অপেক্ষাকৃত নিম্নহার (৫%) যার মধ্যে আছে কৃষি ও শিল্পে ব্যবহৃত উপাদান, অন্যান্য ওষুধ, কাগজ ইত্যাদি এবং আরেকটি সাধারণ হার (১৪%) যা প্রযোজ্য হবে অন্য সমস্ত পণ্যের ক্ষেত্রে। এই সাধারণ হারটিকে গণ্য করা হবে করের নিম্নসীমা হিসাবে, যার ওপরে একটি পরিসর থাকবে রাজ্যগুলির স্বাধিকারের ভিত্তিতে করের স্তরটি স্থির করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। এখানে লক্ষণীয় যে কর কাঠামোর উন্নতির জন্য যে নির্ধারক শর্তাবলী আগে উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই অর্জিত হয় মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা লাগু করার মাধ্যমে।
মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থায় এই উন্নতিগুলি ঘটলেও, এই ব্যবস্থার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু অসম্পূর্ণতাও থেকে যায়। এই অসম্পূর্ণতাগুলি দূর করে আরও উন্নত করকাঠামো চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয় পণ্য ও পরিষেবা কর বা জি এস টি ব্যবস্থা প্রচলন করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে ২০০৭-০৮ সালে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শ্রী পি চিদাম্বরম বাজেট অধিবেশনে ঘোষণা করেন: সমগ্র দেশের জন্য জি এস টি ব্যবস্থার সামগ্রিক কাঠামোটি নির্ণয় করার জন্য রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটিকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
২. জি এস টি ব্যবস্থার কাঠামো
রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি জি এস টি ব্যবস্থার কাঠামো স্থির করার উদ্দেশে রাজ্যগুলির সঙ্গে মতের আদান-প্রদান ছাড়াও, আলোচনা করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকগুলির সঙ্গে এবং কর-বিশেষজ্ঞ ও বণিকসভাগুলির সঙ্গেও। বিভিন্ন স্তরে এই আলোচনা এবং নিজেদের মতের ভিত্তিতে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি জি এস টি-র পূর্ণাঙ্গ কাঠামোর ওপর তাদের রিপোর্ট জমা দেয় দু-বছরের মধ্যেই (১০ই নভেম্বর, ২০০৯) তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির কাছে, এবং এই রিপোর্টটিই জি এস টি কাঠামোর বিষয়ে মূল নির্দেশিকা হিসাবে গৃহীত হয়।
এই রিপোর্টে বলা হয়, মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থায় সাফল্য সত্ত্বেও এর মধ্যে অসম্পূর্ণতাও পরিলক্ষিত হয়েছে, কেন্দ্রীয় মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা এবং রাজ্যগুলিতে মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা, উভয় ক্ষেত্রেই। কেন্দ্রীয় মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থার দুধরনের অসম্পূর্ণতা ছিল : (ক) কেন্দ্রীয় মূল্যযুক্ত করটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ককে। কিন্তু এছাড়াও, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর আছে (যথা, কেন্দ্রীয় অতিরিক্তি উৎপাদন শুল্ক, অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক, বিশেষ অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক, সারচার্জ ইত্যাদি) যাদের কেন্দ্রীয় মূল্যযুক্ত করের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এবং দেওয়া হয়নি উপাদানের ক্ষেত্রে কর-বিয়োগের সুবিধা। এখন এই প্রত্যেকটি করকেই মূল্যযুক্ত করের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে কর-বিয়োগের সুবিধা সমেত। এছাড়া, যেহেতু পরিষেবা করকে লাগু করার অধিকার ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া হয়েছে, তাই এই পরিষেবা করটিকেও মূল্যযুক্ত করের পাশাপাশি রাখতে হবে এবং দিতে হবে কর-বিয়োগের সুবিধা। এইভাবে কর-বিয়োগের সুবিধাসমেত উৎপাদন শুল্কের সঙ্গে অন্যান্য শুল্ককে অন্তর্ভুক্ত করে এবং পরিষেবা করকেও একত্রিত করে গঠিত হবে কেন্দ্রীয় পণ্য ও পরিষেবা কর। (খ) এছাড়াও, কেন্দ্রীয় মূল্যযুক্ত করের ক্ষেত্রে আরও একটি অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। এই করকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে শুধুমাত্র উৎপাদনের স্তরে। এখানে প্রয়োজন এই করটিকে বিক্রির ব্যবস্থাতেও কিছুটা প্রসারিত করে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া।
রাজ্যস্তরে মূল্যযুক্ত করের ক্ষেত্রেও ছিল তিন ধরনের অসম্পূর্ণতা : (ক) বিক্রয় করের ক্ষেত্রে উপাদানের ওপর কর-বিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলেও রাজ্যস্তরে আরও অনেকগুলি কর আছে (যথা, প্রবেশ কর, বিলাস কর, প্রমোদ কর, লটারির ওপর কর ইত্যাদি) যা মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই প্রত্যেকটি করকেই মূল্যযুক্ত করের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; (খ) এছাড়া,সংবিধান সংশোধন করে রাজ্যগুলিকেও অধিকার দিতে হবে পরিষেবা কর লাগু করার, কর-বিয়োগের সুবিধাসমেত পণ্যের ওপর করের পাশাপাশিই রাখতে হবে এই পরিষেবা করের অবস্থান, এবং (গ) আন্তঃরাজ্য বিক্রয়কর একটি বাড়তি করের বোঝা হিসাবে ছিল রাজ্যস্তরে কর ব্যবস্থায়। রাজ্যস্তরে পণ্য ও পরিষেবা কর লাগু করার সময় প্রয়োজন হবে এই করটিকে বিলুপ্ত করা। এইভাবে অসম্পূর্ণতাগুলি দূর করে স্থির হবে রাজ্যস্তরে পণ্য ও পরিষেবা কর।
লক্ষণীয় যে, পণ্য ও পরিষেবা করের দুটি অংশ আছে—একটি কেন্দ্রীয় পণ্য ও পরিষেবা কর বা কেন্দ্রীয় জি এস টি, আরেকটি রাজ্যস্তরে পণ্য ও পরিষেবা কর বা রাজ্য জি এস টি। জি এস টি-র এই দুটি অংশ হলেও, একটি আরেকটির প্রতিবিম্ব। যে সংস্থাগুলির ওপর এই দুই অংশের কর লাগু হবে সেখানে কোনও করের হার যদি স্থির হয় ৫%, তাহলে তা হবে কেন্দ্রীয় জি এস টি-র ক্ষেত্রে ২.৫%, এবং রাজ্য জি এস টি-র ক্ষেত্রেও ২.৫%।
জি এস টি ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র উদ্যোগী বা ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের রিপোর্টে। বলা হয়েছে, যে সমস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোগী বা ব্যবসায়ীদের পণ্যের ক্ষেত্রে এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে মোট বার্ষিক বিক্রয়মূল্য অনধিক ২০ লক্ষ টাকা, তারা জি এস টি-র আওতায় পড়বেন না। এছাড়া, যে সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে বার্ষিক মোট বিক্রয়মূল্য অনধিক ৭৫ লক্ষ টাকা, তারাও তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সুযোগ পাবে বিশদ হিসাবের মধ্যে না গিয়ে মোট বিক্রয়মূল্যের একটি ছোট অংশ (যথা, ১% কেন্দ্রীয় জি এস টি এবং ১% রাজ্য জি এস টি-র ক্ষেত্রে) সরলীকৃত পদ্ধতিতে কর হিসাবে জমা দেওয়ার। এছাড়া পণ্যের ক্ষেত্রে কোনও সংস্থার বার্ষিক মোট বিক্রয়মূল্য অনধিক ১.৫ কোটি টাকা হলে, তাকে শুধুমাত্র রাজ্য সরকারকে জি এস টি-র পণ্যের অংশটি কর হিসাবে প্রদান করতে হবে।
এছাড়া, জি এস টি ব্যবস্থায় কর কাঠামোর ক্ষেত্রে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে মত দেয় যে, নির্দিষ্ট করের হার জি এস টি লাগু করার ঠিক আগে জানানো উচিত হবে, তবে এই কাঠামো সরল রাখতে হবে—একটি করযুক্ত তালিকা এবং সোনা ও রুপার জন্য বিশেষ কর ছাড়া দুটি মাত্র করের স্তর থাকবে — একটি নিম্নহার এবং একটি সাধারণ হার, যেখানে নিম্নস্তর ছাড়া থাকবে একটি পরিসর রাজ্যগুলির কর হার বেছে নেওয়ার স্বাধিকারকে মর্যাদা জানিয়ে)।
৩. জি এস টি রূপায়ণের ক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থা
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১০-১১ সালের পর থেকে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটির সভাপতির পদটিতে পরিবর্তন হয়েছে এবং বর্তমানে এই কমিটি দৃশ্যতঃ কম ক্রিয়াশীল অবস্থাতেও আছে। এছাড়া, জি এস টি লাগু করার জন্য যে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে, সেখানে ২৭৯(ক) ধারা অনুযায়ী গঠিত হয়েছে একটি জি এস টি পর্ষদ, যার সভাপতি হয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এবং সদস্য হিসাবে রয়েছেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরা। এই পর্ষদে সহ-সভাপতি হিসাবে থাকার কথা রাজ্যের কোনও অর্থমন্ত্রীর, কিন্তু এই পদটি শূন্যই রাখা হয়েছে। এই ২৭৯(ক) ধারাতেই (ঙ) উপধারা অনুযায়ী এই পর্ষদ কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির কাছে জি এস টি ব্যবস্থায় করের হারগুলি সুপারিশ করবে। এখানে একইসঙ্গে সুপারিশ করার কথা করের হারের ওপরে একটি পরিসরের, রাজ্যগুলির স্বাধিকারের ক্ষেত্রে মর্যাদা জানিয়ে। কিন্তু লক্ষণীয়, এই পরিসরের বিষয়ে কোনও সুপারিশই করেনি বর্তমান জি এস টি পর্ষদ। অর্থাৎ, কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির স্বাধিকারের বিষয়টিতে আঘাত করা হয়েছে শুরুতেই।
এছাড়া উল্লেখ করা দরকার, যেখানে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল যে, করমুক্ত তালিকা এবং সোনা ও রুপার ক্ষেত্রে বিশেষ হারের পরে থাকবে মাত্র দুটি করের হার — একটি অপেক্ষাকৃত নিম্নহার এবং আরেকটি সাধারণ হার, সেখানে এই জি এস টি পর্ষদ করমুক্ত তালিকা এবং সোনা ও রুপার বিশেষ হার ছাড়া আগেকার দু’টি হারের জায়গায় ৪টি জি এস টি হারের সুপারিশ করেছে — ৫%, ১২%, ১৮%, ২৮%। এত বেশি সংখ্যক করের হার কেন? কেনই বা এত উঁচু ২৮% করের হার, যা পৃথিবীর প্রায় অন্য কোনও দেশে নেই?
এছাড়া, কতগুলি হারের ক্ষেত্রে যা সুপারিশ করা হয়েছে তা সংশোধন না করলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হবে, বিশেষ করে বর্ধিত মূল্যবৃদ্ধির কারণে। ওষুধের ক্ষেত্রে, আগে মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থায় সমস্ত জীবনদায়ী ওষুধ ছিল করমুক্ত তালিকায় এবং বাকি সমস্ত ওষুধগুলি ছিল ৫% হারের তালিকায়। এখন জীবনদায়ী ওষুধের তালিকা খর্ব করে ওষুধগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ৫%, ১২%, এমনকি ১৮% করের তালিকাতেও। এমনকি প্রতিবন্ধীদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যথাক্রমে ৫% এবং ১২% করের তালিকাতে। আমরা মনে করি, এখানে উচিত হবে, সমস্ত জীবনদায়ী ওষুধ, প্রতিবন্ধীদের ব্যবহারের সরঞ্জাম এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনকে করমুক্ত রাখা, এবং অন্য সমস্ত ওষুধকে অন্তর্ভুক্ত ৫% শতাংশ করের তালিকায়। এছাড়া, অপেক্ষাকৃত নিম্নআয়ের পরিবারের মহিলাদের ব্যবহারের কৃত্রিম তন্তুর শাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে করের হার হ্রাস করা উচিত ১৮% থেকে ৫%-এ।
এই সমস্ত আবশ্যকীয় পণ্যের করের হার হ্রাস না করলে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলির মূল্যগুলি আরও তীব্র হবে, যা এখন পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া, ক্ষুদ্রশিল্পে প্রস্তুত বেশ কিছু পণ্য, যেমন মাছ ধরার বঁড়শি, পচনশীল মিষ্টান্নকে (যা এরাজ্যে আগে ছিল করহীন) করমুক্ত তালিকাতেই রাখা উচিত। উল্লেখ করা প্রয়োজন, যে সকল ক্ষেত্রে আগে সেস আরোপ করা হতো শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে (যথা বিড়ি শ্রমিকের স্বার্থে সেস ইত্যাদি), সেখানে এখন কেন্দ্রীয় জি এস টি-তে সেস তুলে দেওয়ার পর শ্রমিক কল্যাণে প্রয়োজনীয় অর্থের উৎস কী হবে, তা জানানো হয়নি। আমাদের দাবি হওয়া উচিত, এই সমস্ত ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাজেটে সমপরিমাণ অর্থবরাদ্দ করতে হবে, এবং নিশ্চিত করতে হবে যাতে এই অর্থ বরাদ্দের বার্ষিক বৃদ্ধির হার জি এস টি-তে মোট কর রাজস্ব বৃদ্ধির হারের সমান থাকে। উপরে উল্লিখিত সংশোধন/সংযোজন জরুরি, তা না হলে ক্ষতি হবে সাধারণ মানুষের এবং রাজ্যের স্বার্থের।
এছাড়া, যেহেতু জি এস টি ব্যবস্থার রূপায়ণ কম্পিউটার-নির্ভর এবং সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রায় ৬০%-র কম্পিউটার নেই বা ব্যবহারের সুযোগ নেই, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারকে জি এস টি এবং রাজ্যগুলির স্বার্থে আর্থিক সাহায্য করতে হবে কম্পিউটার ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকৃতভাবে লাগু করার ক্ষেত্রে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জি এস টি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সাধারণ ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোগীদের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তি দূর করার লক্ষ্যে এখনই প্রয়োজন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সর্বভারতীয় স্তরে, এবং প্রত্যেকটি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্যস্তরে এবং প্রত্যেকটি জেলার স্তরে (এবং প্রয়োজনে আরও নিচের স্তরে) সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সমিতিগুলির সঙ্গে এবং সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গেও জি এস টি-র ব্যবহারিক বিষয়গুলি নিয়ে নিবিড়ভাবে আলোচনা করা।
৪. উপেক্ষিত সম্ভাবনা
জি এস টি ব্যবস্থার একটি প্রয়োগের বিষয় বিবেচনা করা উচিত, যা এখনো উপেক্ষিত হয়ে আছে। আমরা জানি যে, কোনও সংস্থার ক্ষেত্রে বছরে মোট মুনাফার পরিমাণ হবে ওই সংস্থার পণ্যের বিক্রয়লব্ধ উপার্জন থেকে ওই সংস্থায় ব্যবহৃত কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের (পরিষেবা সমেত) ব্যয় এবং শ্রমিকদের মজুরির জন্য ব্যয় বাদ দেওয়া। এখন এই সমীকরণকে ব্যবহার করলেই বোঝা যায় যে, মোট মুনাফা যুক্ত মোট মজুরি (অর্থাৎ এই সংস্থা থেকে মোট আয়) হবে বিক্রয়লব্ধ উপার্জন বিযুক্ত কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের খাতে ব্যয়। এর ফলে জি এস টি ব্যবস্থা লাগু হলে, প্রতি বছরেই বিক্রয়লব্ধ উপার্জন এবং কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের ব্যয়ের হিসাব থেকে ধারাবাহিকভাবেই জানা যাবে সেই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত মোট আয়ের তথ্য। এরপর যদি ঐ আয়ের তুলনায় আয়কর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যের তফাত হয়, তখনই বোঝা যাবে কর ফাঁকি দেওয়া কালো টাকার উৎস এবং হিসাব। কিন্তু জি এস টি ব্যবস্থার প্রয়োগ থেকেই যে জানা সম্ভব কালো টাকার উৎস, এই বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে রয়েছে সর্বভারতীয় স্তর থেকে, শ্রেণিস্বার্থের কারণেই।
Courtesy: http://www.ganashakti.com/bengali