What is GST ?

August 8, 2017

বর্তমান জি এস টি ব্যবস্থার সংশোধন জরুরি

ড. অসীম দাশগুপ্ত

দেশে চালু হয়েছে পণ্য ও পরিষেবা কর বা জি এস টি। জি এস টি-র উৎস কি? জি এস টি-র কাঠামো কেমন? জি এস টি-র ফলে দাম বাড়ছে কোন কোন পণ্যের এই জি এস টি ব্যবস্থা কোন শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করছে? এসবেরই বিশ্লেষণ করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। পণ্য ও পরিষেবা কর (ইংরেজিতে Goods and Services Tax, সংক্ষেপে G S T, বাংলায় জি এস টি)—এই বিষয়ে আমাদের বক্তব্য চারটি অংশে ভাগ করে পেশ করব। প্রথমেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক : জি এস টি-র বিষয়টি এল কি করে? এর পরিপ্রেক্ষিতটা কি? এই পরিপ্রেক্ষিতটি ব্যাখ্যা করেই শুরু করা হবে প্রথম অংশের আলোচনা। পরিপ্রেক্ষিত সামনে রেখে জি এস টি-র কাঠামো, যা রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তুত করেছিল, তার বিশ্লেষণ থাকবে দ্বিতীয় অংশের আলোচনায়। কিন্তু বর্তমানে সর্বভারতীয় স্তর থেকে যে কাঠামো অনুসরণ করার চেষ্টা চলেছে, তা কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের প্রস্তুত করা কাঠামোর থেকে ভিন্ন। এর ফলে বর্তমানে এই কাঠামো অনুসরণ করার কারণে এই সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে বর্তমান কাঠামোর এই ক্ষেত্রগুলিতে সংশোধন করা জরুরি। তা না হলে সাধারণ মানুষের এবং রাজ্যগুলির ব্যাপকভাবে ক্ষতি হবে বিশেষ করে তীব্রতর মূল্যবৃদ্ধি এবং রাজ্যের স্বাধিকার হরণের মাধ্যমে। এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়েছে তৃতীয় অংশের আলোচনায়। এছাড়া, জি এস টি ব্যবস্থাকে একটি বিশেষভাবে ব্যবহার করা সম্ভব যা কালো টাকা উদ্ধারের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে, যে বিষয়টি বর্তমান অবস্থায় উপেক্ষিত থেকেছে শ্রেণি স্বার্থের কারণে। এই প্রসঙ্গের আলোচনা থাকবে চতুর্থ অংশে।

১. পরিপ্রেক্ষিত

জি এস টি লাগু করার সময়ে বলা হয়েছে, এরফলে কর ব্যবস্থার আরও উন্নতি হবে। কর ব্যবস্থার উন্নতি, এর মানে কি? এর মানে কর ব্যবস্থায় এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যার ফলে সাধারণ কৃষক, শিল্পোদ্যোগী এবং ব্যবসায়ী প্রত্যেকেরই করের বোঝা লাঘব হবে, এবং এর ফলে সম্ভাবনা থাকবে মূল্য হ্রাসের, যাতে উপকৃত হতে পারেন সাধারণ ক্রেতারাও। এছাড়া, একই সঙ্গে অর্জন করতে হবে কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলিতে কর রাজস্বের বৃদ্ধি, এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে সুরক্ষিত থাকে রাজ্যগুলির স্বাধিকারের বিষয়টিও।

কর ব্যবস্থার উন্নতির এই সমগ্র বিষয়গুলির আলোচনার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভার কথা (১৬ই নভেম্বর, ১৯৯৯), যা আহ্বান করেছিলেন তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শ্রীযশোবন্ত সিন্‌হা এবং উপস্থিত ছিলেন শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসু। ওই সভা চলাকালীন যশোবন্ত সিন্‌হা মঞ্চ থেকে নেমে এসে জ্যোতি বসুর সঙ্গে আলোচনা করেন। ওই সভাতে সিদ্ধান্ত হয়, কর ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে রাজ্যগুলির অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হবে। পরে ২০০০ সালে স্থির হয়, এই কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও মনোনীত কমিটি হবে না। এই কমিটি হবে নথিভুক্ত সংস্থার আইনে গঠিত রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি, এবং এই কমিটি দু’বছরের জন্য রাজ্যের একজন অর্থমন্ত্রীকে সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত করবে। এই পদে পাঁচ বার পুনর্নির্বাচিত হয়ে প্রায় দশ বছর (২০০০-০১ থেকে ২০১০-১১) আমাদের কাজ করার সুযোগ হয়।

এই কাজ করতে গিয়ে প্রথমেই আমরা লক্ষ্য করি, প্রত্যেকটি রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয় স্তরেও, সেই সময় কর ব্যবস্থার মধ্যে করের ওপর কর চাপানোর ফলে করের একটি বাড়তি বোঝা সৃষ্টি হয়ে আছে। করের ওপর কর চাপানোর বিষয়টি ছিল এইরকম। কোনও একটি পণ্য উৎপাদন করার সময় যে কাঁচামাল বা উপাদান ব্যবহার করা হতো, তার ওপর প্রথমে একবার কর দিতে হতো উৎপাদকদের। তারপর এই করের বোঝা নিয়ে যখন পণ্যটি উৎপাদিত হতো, তখন সেই পণ্যটির ওপর পুনরায় কর চাপানো হতো, অর্থাৎ, করের ওপর করের বোঝা চাপত। এর ফলে, উৎপাদনের খরচ এবং পণ্যটির দামও বৃদ্ধি পেত, এবং সামগ্রিকভাবে উৎপাদক, বিক্রেতা এবং ক্রেতা সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটির পক্ষ থেকে আমরা সর্বসম্মতিক্রমে মূল্যযুক্ত কর (ইংরেজিতে Value Added Tax, বা সংক্ষেপে VAT) ব্যবস্থা লাগু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।

এই ব্যবস্থার মূল বিষয় হল, পণ্যের ওপর প্রদেয় কর থেকে উপাদানের ওপর চাপানো করটি বাদ দেওয়ার সুযোগ প্রদান করা। এর ফলে পণ্যের ওপর করের বাড়তি বোঝা লাঘব হয়ে যায়। মূল্যযুক্ত কর লাগু করার এই সিদ্ধান্ত রাজ্যগুলির জন্য লাগু হয় ২০০৫-০৬ সালে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের স্তরে ২০০২-০৩ সালে। এরফলে, পূর্বে উল্লিখিত কারণে, পণ্যের ওপর করের বোঝা হ্রাস পায় এবং এর থেকে উপকৃত হন উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা, এবং কর হ্রাসের কারণে মূল্যহ্রাসের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়। এছাড়া, উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেহেতু পণ্যের ওপর প্রদেয় কর থেকে উপাদানের ওপর কর বিয়োগের সুবিধা পেতে হলে আগেকার স্তরে করটি অবশ্যই দিতে হবে এবং তার রসিদ দেখাতে হবে, তাই এই স্তরে কর ফাঁকি রোধের জন্য নজরদারি ব্যবসায়ীরা নিজেরাই নিজেদের স্বার্থে নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন এবং বৃদ্ধি পাবে কর রাজস্ব আদায়ও। বস্তুত লক্ষ্য করা গেল, রাজ্যস্তরে মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগের পাঁচ বছরে যেখানে রাজ্যগুলির বিক্রয়কর থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির গড় বার্ষিক হার ছিল ১১%, সেখানে মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরের পাঁচ বছরে কর রাজস্ব বৃদ্ধির গড় হার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২২% (এবং পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ২০১০-১১ সালে এই বৃদ্ধির হার হয় ২৫%)।

এছাড়া, রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থার ক্ষেত্রে করের হারের সংখ্যাও কমানো হবে। একটি করমুক্ত পণ্যের তালিকা (যার মধ্যে খাদ্যশস্য, জীবনদায়ী ওষুধ, নিম্ন আয়ের মানুষদের ব্যবহারের অন্যান্য আবশ্যকীয় পণ্য, এবং সোনা ও রুপার জন্য বিশেষ করের হার (১%) ছাড়া থাকবে কেবলমাত্র দুটি করের হার—একটি অপেক্ষাকৃত নিম্নহার (৫%) যার মধ্যে আছে কৃষি ও শিল্পে ব্যবহৃত উপাদান, অন্যান্য ওষুধ, কাগজ ইত্যাদি এবং আরেকটি সাধারণ হার (১৪%) যা প্রযোজ্য হবে অন্য সমস্ত পণ্যের ক্ষেত্রে। এই সাধারণ হারটিকে গণ্য করা হবে করের নিম্নসীমা হিসাবে, যার ওপরে একটি পরিসর থাকবে রাজ্যগুলির স্বাধিকারের ভিত্তিতে করের স্তরটি স্থির করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। এখানে লক্ষণীয় যে কর কাঠামোর উন্নতির জন্য যে নির্ধারক শর্তাবলী আগে উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই অর্জিত হয় মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা লাগু করার মাধ্যমে।

মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থায় এই উন্নতিগুলি ঘটলেও, এই ব্যবস্থার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু অসম্পূর্ণতাও থেকে যায়। এই অসম্পূর্ণতাগুলি দূর করে আরও উন্নত করকাঠামো চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয় পণ্য ও পরিষেবা কর বা জি এস টি ব্যবস্থা প্রচলন করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে ২০০৭-০৮ সালে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শ্রী পি চিদাম্বরম বাজেট অধিবেশনে ঘোষণা করেন: সমগ্র দেশের জন্য জি এস টি ব্যবস্থার সামগ্রিক কাঠামোটি নির্ণয় করার জন্য রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটিকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

২. জি এস টি ব্যবস্থার কাঠামো

রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি জি এস টি ব্যবস্থার কাঠামো স্থির করার উদ্দেশে রাজ্যগুলির স‌ঙ্গে মতের আদান-প্রদান ছাড়াও, আলোচনা করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকগুলির সঙ্গে এবং কর-বিশেষজ্ঞ ও বণিকসভাগুলির সঙ্গেও। বিভিন্ন স্তরে এই আলোচনা এবং নিজেদের মতের ভিত্তিতে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি জি এস টি-র পূর্ণাঙ্গ কাঠামোর ওপর তাদের রিপোর্ট জমা দেয় দু-বছরের মধ্যেই (১০ই নভেম্বর, ২০০৯) তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির কাছে, এবং এই রিপোর্টটিই জি এস টি কাঠামোর বিষয়ে মূল নির্দেশিকা হিসাবে গৃহীত হয়।

এই রিপোর্টে বলা হয়, মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থায় সাফল্য সত্ত্বেও এর মধ্যে অসম্পূর্ণতাও পরিলক্ষিত হয়েছে, কেন্দ্রীয় মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা এবং রাজ্যগুলিতে মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা, উভয় ক্ষেত্রেই। কেন্দ্রীয় মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থার দুধরনের অসম্পূর্ণতা ছিল : (ক) কেন্দ্রীয় মূল্যযুক্ত করটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ককে। কিন্তু এছাড়াও, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর আছে (যথা, কেন্দ্রীয় অতিরিক্তি উৎপাদন শুল্ক, অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক, বিশেষ অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক, সারচার্জ ইত্যাদি) যাদের কেন্দ্রীয় মূল্যযুক্ত করের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এবং দেওয়া হয়নি উপাদানের ক্ষেত্রে কর-বিয়োগের সুবিধা। এখন এই প্রত্যেকটি করকেই মূল্যযুক্ত করের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হ‍‌বে কর-বিয়োগের সুবিধা সমেত। এছাড়া, যেহেতু প‍‌রিষেবা করকে লাগু করার অধিকার ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া হয়েছে, তাই এই পরিষেবা করটিকেও মূল্যযুক্ত করের পাশাপাশি রাখতে হবে এবং দিতে হবে কর-বিয়োগের সুবিধা। এইভাবে কর-বিয়োগের সুবিধাসমেত উৎপাদন শুল্কের সঙ্গে অন্যান্য শুল্ককে অন্তর্ভুক্ত করে এবং পরিষেবা করকেও একত্রিত করে গঠিত হবে কেন্দ্রীয় পণ্য ও পরিষেবা কর। (খ) এছাড়াও, কেন্দ্রীয় মূল্যযুক্ত করের ক্ষেত্রে আরও একটি অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। এই করকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে শুধুমাত্র উৎপাদনের স্তরে। এখানে প্রয়োজন এই করটিকে বিক্রির ব্যবস্থাতেও কিছুটা প্রসারিত করে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া।

রাজ্যস্তরে মূল্যযুক্ত করের ক্ষেত্রেও ছিল তিন ধরনের অসম্পূর্ণতা : (ক) বিক্রয় করের ক্ষেত্রে উপাদানের ওপর কর-বিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলেও রাজ্যস্তরে আরও অনেকগুলি কর আছে (যথা, প্রবেশ কর, বিলাস কর, প্রমোদ কর, লটারির ওপর কর ইত্যাদি) যা মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই প্রত্যেকটি করকেই মূল্যযুক্ত করের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; (খ) এছাড়া,সংবিধান সংশোধন করে রাজ্যগুলিকেও অধিকার দিতে হবে পরিষেবা কর লাগু করার, কর-বিয়োগের সুবিধাসমেত পণ্যের ওপর করের পাশাপাশিই রাখতে হবে এই পরিষেবা করের অবস্থান, এবং (গ) আন্তঃরাজ্য বিক্রয়কর একটি বাড়তি করের বোঝা হিসাবে ছিল রাজ্যস্তরে কর ব্যবস্থায়। রাজ্যস্তরে পণ্য ও পরিষেবা কর লাগু করার সময় প্রয়োজন হবে এই করটিকে বিলুপ্ত করা। এইভাবে অসম্পূর্ণতাগুলি দূর করে স্থির হবে রাজ্যস্তরে পণ্য ও পরিষেবা কর।

লক্ষণীয় যে, পণ্য ও পরিষেবা করের দুটি অংশ আছে—একটি কেন্দ্রীয় পণ্য ও পরিষেবা কর বা কেন্দ্রীয় জি এস টি, আরেকটি রাজ্যস্তরে পণ্য ও পরিষেবা কর বা রাজ্য জি এস টি। জি এস টি-র এই দুটি অংশ হলেও, একটি আরেকটির প্রতিবিম্ব। যে সংস্থাগুলির ওপর এই দুই অংশের কর লাগু হবে সেখানে কোনও করের হার যদি স্থির হয় ৫%, তাহলে তা হবে কেন্দ্রীয় জি এস টি-র ক্ষেত্রে ২.৫%, এবং রাজ্য জি এস টি-র ক্ষেত্রেও ২.৫%।

জি এস টি ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র উদ্যোগী বা ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের রিপোর্টে। বলা হয়েছে, যে সমস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোগী বা ব্যবসায়ীদের পণ্যের ক্ষেত্রে এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে মোট বার্ষিক বিক্রয়মূল্য অনধিক ২০ লক্ষ টাকা, তারা জি এস টি-র আওতায় পড়বেন না। এছাড়া, যে সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে বার্ষিক মোট বিক্রয়মূল্য অনধিক ৭৫ লক্ষ টাকা, তারাও তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সুযোগ পাবে বিশদ হিসাবের মধ্যে না গিয়ে মোট বিক্রয়মূল্যের একটি ছোট অংশ (যথা, ১% কেন্দ্রীয় জি এস টি এবং ১% রাজ্য জি এস টি-র ক্ষেত্রে) সরলীকৃত পদ্ধতিতে কর হিসাবে জমা দেওয়ার। এছাড়া পণ্যের ক্ষেত্রে কোনও সংস্থার বার্ষিক মোট বিক্রয়মূল্য অনধিক ১.৫ কোটি টাকা হলে, তাকে শুধুমাত্র রাজ্য সরকারকে জি এস টি-র পণ্যের অংশটি কর হিসাবে প্রদান করতে হবে।

এছাড়া, জি এস টি ব্যবস্থায় কর কাঠামোর ক্ষেত্রে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে মত দেয় যে, নির্দিষ্ট করের হার জি এস টি লাগু করার ঠিক আগে জানানো উচিত হবে, তবে এই কাঠামো সরল রাখতে হবে—একটি করযুক্ত তালিকা এবং সোনা ও রুপার জন্য বিশেষ কর ছাড়া দুটি মাত্র করের স্তর থাকবে — একটি নিম্নহার এবং একটি সাধারণ হার, যেখানে নিম্নস্তর ছাড়া থাকবে একটি পরিসর রাজ্যগুলির কর হার বেছে নেওয়ার স্বাধিকারকে মর্যাদা জানিয়ে)।

৩. জি এস টি রূপায়ণের ক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থা

উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১০-১১ সালের পর থেকে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটির সভাপতির পদটিতে পরিবর্তন হয়েছে এবং বর্তমানে এই কমিটি দৃশ্যতঃ কম ক্রিয়াশীল অবস্থাতেও আছে। এছাড়া, জি এস টি লাগু করার জন্য যে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে, সেখানে ২৭৯(ক) ধারা অনুযায়ী গঠিত হয়েছে একটি জি এস টি পর্ষদ, যার সভাপতি হয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এবং সদস্য হিসাবে রয়েছেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরা। এই পর্ষদে সহ-সভাপতি হিসাবে থাকার কথা রাজ্যের কোনও অর্থমন্ত্রীর, কিন্তু এই পদটি শূন্যই রাখা হয়েছে। এই ২৭৯(ক) ধারাতেই (ঙ) উপধারা অনুযায়ী এই পর্ষদ কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির কাছে জি এস টি ব্যবস্থায় করের হারগুলি সুপারিশ করবে। এখানে একইসঙ্গে সুপারিশ করার কথা করের হারের ওপরে একটি পরিসরের, রাজ্যগুলির স্বাধিকারের ক্ষেত্রে মর্যাদা জানিয়ে। কিন্তু লক্ষণীয়, এই পরিসরের বিষয়ে কোনও সুপারিশই করেনি বর্তমান জি এস টি পর্ষদ। অর্থাৎ, কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির স্বাধিকারের বিষয়টিতে আঘাত করা হয়েছে শুরুতেই।

এছাড়া উল্লেখ করা দরকার, যেখানে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল যে, করমুক্ত তালিকা এবং সোনা ও রুপার ক্ষেত্রে বিশেষ হারের পরে থাকবে মাত্র দুটি করের হার — একটি অপেক্ষাকৃত নিম্নহার এবং আরেকটি সাধারণ হার, সেখানে এই জি এস টি পর্ষদ করমুক্ত তালিকা এবং সোনা ও রুপার বিশেষ হার ছাড়া আগেকার দু’টি হারের জায়গায় ৪টি জি এস টি হারের সুপারিশ করেছে — ৫%, ১২%, ১৮%, ২৮%। এত বেশি সংখ্যক করের হার কেন? কেনই বা এত উঁচু ২৮% করের হার, যা পৃথিবীর প্রায় অন্য কোনও দেশে নেই?

এছাড়া, কতগুলি হারের ক্ষেত্রে যা সুপারিশ করা হয়েছে তা সংশোধন না করলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হবে, বিশেষ করে বর্ধিত মূল্যবৃদ্ধির কারণে। ওষুধের ক্ষেত্রে, আগে মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থায় সমস্ত জীবনদায়ী ওষুধ ছিল করমুক্ত তালিকায় এবং বাকি সমস্ত ওষুধগুলি ছিল ৫% হারের তালিকায়। এখন জীবনদায়ী ওষুধের তালিকা খর্ব করে ওষুধগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ৫%, ১২%, এমনকি ১৮% করের তালিকাতেও। এমনকি প্রতিবন্ধীদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যথাক্রমে ৫% এবং ১২% করের তালিকাতে। আমরা মনে করি, এখানে উচিত হবে, সমস্ত জীবনদায়ী ওষুধ, প্রতিবন্ধীদের ব্যবহারের সরঞ্জাম এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনকে করমুক্ত রাখা, এবং অন্য সমস্ত ওষুধকে অন্তর্ভুক্ত ৫% শতাংশ করের তালিকায়। এছাড়া, অপেক্ষাকৃত নিম্নআয়ের পরিবারের মহিলাদের ব্যবহারের কৃত্রিম তন্তুর শাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে করের হার হ্রাস করা উচিত ১৮% থেকে ৫%-এ।

এই সমস্ত আবশ্যকীয় পণ্যের করের হার হ্রাস না করলে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলির মূল্যগুলি আরও তীব্র হবে, যা এখন পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া, ক্ষুদ্রশিল্পে প্রস্তুত বেশ কিছু পণ্য, যেমন মাছ ধরার বঁড়শি, পচনশীল মিষ্টান্নকে (যা এরাজ্যে আগে ছিল করহীন) করমুক্ত তালিকাতেই রাখা উচিত। উল্লেখ করা প্রয়োজন, যে সকল ক্ষেত্রে আগে সেস আরোপ করা হতো শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে (যথা বিড়ি শ্রমিকের স্বার্থে সেস ইত্যাদি), সেখানে এখন কেন্দ্রীয় জি এস টি-তে সেস তুলে দেওয়ার পর শ্রমিক কল্যাণে প্রয়োজনীয় অর্থের উৎস কী হবে, তা জানানো হয়নি। আমাদের দাবি হওয়া উচিত, এই সমস্ত ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাজেটে সমপরিমাণ অর্থবরাদ্দ করতে হবে, এবং নিশ্চিত করতে হবে যাতে এই অর্থ বরাদ্দের বার্ষিক বৃদ্ধির হার জি এস টি-তে মোট কর রাজস্ব বৃদ্ধির হারের সমান থাকে। উপরে উল্লিখিত সংশোধন/সংযোজন জরুরি, তা না হলে ক্ষতি হবে সাধারণ মানুষের এবং রাজ্যের স্বার্থের।

এছাড়া, যেহেতু জি এস টি ব্যবস্থার রূপায়ণ কম্পিউটার-নির্ভর এবং সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রায় ৬০%-র কম্পিউটার নেই বা ব্যবহারের সুযোগ নেই, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারকে জি এস টি এবং রাজ্যগুলির স্বার্থে আর্থিক সাহায্য করতে হবে কম্পিউটার ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকৃতভাবে লাগু করার ক্ষেত্রে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জি এস টি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সাধারণ ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোগীদের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তি দূর করার লক্ষ্যে এখনই প্রয়োজন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সর্বভারতীয় স্তরে, এবং প্রত্যেকটি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্যস্তরে এবং প্রত্যেকটি জেলার স্তরে (এবং প্রয়োজনে আরও নিচের স্তরে) সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সমিতিগুলির সঙ্গে এবং সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গেও জি এস টি-র ব্যবহারিক বিষয়গুলি নিয়ে নিবিড়ভাবে আলোচনা করা।

৪. উপেক্ষিত সম্ভাবনা

‍‌জি এস টি ব্যবস্থার একটি প্রয়োগের বিষয় বিবেচনা করা উচিত, যা এখনো উপেক্ষিত হয়ে আছে। আমরা জানি যে, কোনও সংস্থার ক্ষেত্রে বছরে মোট মুনাফার পরিমাণ হবে ওই সংস্থার পণ্যের বিক্রয়লব্ধ উপার্জন থেকে ওই সংস্থায় ব্যবহৃত কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের (পরিষেবা সমেত) ব্যয় এবং শ্রমিকদের মজুরির জন্য ব্যয় বাদ দেওয়া। এখন এই সমীকরণকে ব্যবহার করলেই বোঝা যায় যে, মোট মুনাফা যুক্ত মোট মজুরি (অর্থাৎ এই সংস্থা থেকে মোট আয়) হবে বিক্রয়লব্ধ উপার্জন ‍‌বিযুক্ত কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের খাতে ব্যয়। এর ফলে জি এস টি ব্যবস্থা লাগু হলে, প্রতি বছরেই বিক্রয়লব্ধ উপার্জন এবং কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের ব্যয়ের হিসাব থেকে ধারাবাহিকভাবেই জানা যাবে সেই সংস্থার স‍‌ঙ্গে যুক্ত মোট আয়ের তথ্য। এরপর যদি ঐ আয়ের তুলনায় আয়কর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যের তফাত হয়, তখনই বোঝা যাবে কর ফাঁকি দেওয়া কালো টাকার উৎস এবং হিসাব। কিন্তু জি এস টি ব্যবস্থার প্রয়োগ থেকেই যে জানা সম্ভব কালো টাকার উৎস, এই বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে রয়েছে সর্বভারতীয় স্তর থেকে, শ্রেণিস্বার্থের কারণেই।


   Courtesy: http://www.ganashakti.com/bengali

Sangh-Inspired Film Censor Board

July 13, 2017

অমর্ত্য সেনকে নিয়ে তথ্যচিত্রে কোপ
তীব্র ক্ষোভের মুখে সেন্সর বোর্ড

নয়াদিল্লি ও কলকাতা, ১২ই জুলাই– তাঁকে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রে কয়েকটি অতি সাধারণ শব্দেও সেন্সর বোর্ডের নিষেধাজ্ঞায় বিস্মিত অমর্ত্য সেন বলেছেন, এ থেকে প্রমাণ হচ্ছে দেশ এক স্বৈরাচারী রাজত্বের হাতে চলে গেছে। দেশের পক্ষে কী ভালো তা তারাই একমাত্র স্থির করবেন এবং চাপিয়ে দেবেন দেশের মানুষের ওপরে।অমর্ত্য সেনের জীবন ও কাজ নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র ‘দি আর্গুমেনটেটিভ ইন্ডিয়ান’—এর পরিচালক সুমন ঘোষকে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন জানিয়েছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের উচ্চারিত কয়েকটি শব্দ বাদ দিতে হবে। পরিচালক জানিয়েছেন, অন্তত চারটি শব্দ বাদ দিতে বলা হয়েছে: গোরু, গুজরাট, ভারত সম্পর্কে হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, হিন্দু ভারত। কলকাতায় সেন্সর বোর্ডের দপ্তরে তিন ঘণ্টা ধরে তথ্যচিত্রটি খুঁটিয়ে দেখার পরে বোর্ডের তরফে ওই রায় দেওয়া হয়েছে। পরিচালক বুধবার বলেছেন, তাঁকে মৌখিক ভাবেই ওই শব্দগুলি বাদ দিতে বলা হয়েছে। আমি এ ব্যাপারে আমার অপারগতার কথা জানিয়েছি।

পরিচলাক সুমন ঘোষ বলেছেন, তথ্যচিত্রটি নির্মিত হয়েছে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর ছাত্র ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর কথোপকথনের ধাঁচে। এই আলোচনার মধ্যে থেকে কয়েকটি শব্দ বাদ দিলে তথ্যচিত্রের মর্মবস্তুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি সেন্সর বোর্ডের লিখিত বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করছি। মুম্বাইয়ে রিভিউ কমিটিকে পাঠাবে কিনা, তা-ও দেখতে হবে। তবে যে কোনো পরিস্থিতিতেই আমার উত্তর হবে একই। হয়তো বিষয়টি মিটে যাবে, কিন্তু আমি কোনও শব্দ সরিয়ে নেব না। সুমন ঘোষ নিজেও অর্থনীতির শিক্ষক। ২০০২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ১৫ বছরে ছবিটি নির্মিত।

অমর্ত্য সেন নিজে এই ঘটনা জেনে ‘বিস্মিত’। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় তিনি বলেছেন, এমনিতে ‘গোরু’ আমার খুব পছন্দের শব্দ এমন নয়। আসলে গোরু নয়, আপত্তি গুজরাট নিয়ে। এই নয় যে গুজরাট শুনলেই ওঁরা আপত্তি করবেন। ২০০২-এ গুজরাটে কী ঘটেছিল সেটা বলেছি বলে এই আপত্তি।

জানা গেছে, তথ্যচিত্রে গুজরাটের ২০০২-র ঘটনাবলীর উল্লেখ এসেছে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অমর্ত্য সেনের একটি বক্তৃতায়। সেই ভাষণে গণতন্ত্রের গুরুত্বের কথা বোঝাতে গিয়ে গুজরাটে সরকারি মদতে অপরাধের কথা এসেছিল। এই তথ্যচিত্র ইতিমধ্যেই লন্ডন ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে।

কৌশিক বসু মন্তব্য করেছেন, ভারতের মতো দেশের মর্যাদার সঙ্গে, অমর্ত্য সেনকে সেন্সর করা, মেলে না। ভারত যেসব দেশের প্রতিনিয়ত সমালোচনা করে থাকে, এই ব্যবহার তাদের সঙ্গেই তুলনীয়।

সেন্সর বোর্ডের নির্দেশ নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। বিশিষ্ট শিল্পী, বুদ্ধিবৃত্তির জগতের মানুষজন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, কোন্‌ ফতোয়ায় সেন্সর বোর্ড চলছে। বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এদিন বলেন, সেন্সর বোর্ড একটি রাজনৈতিক দলের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তাঁবেদার সংগঠনের কাজ করছে। অমর্ত্য সেন কী বলবেন, তা-ও কি ওঁরা ঠিক করে দেবেন নাকি? এ হলো মূর্খামি। এ শুধু সিনেমা জগতের ব্যাপার নয়, সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষেরই উচিত এর জোরালো প্রতিবাদ করা।

অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, এ তো এক ধরনের ফ্যাসিবাদ। যাঁর মুখের শব্দ নিয়ে আপত্তি করা হচ্ছে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত এক ব্যক্তি। সুতরাং এ চরম বোকামিও। তবে এই সরকারের কাছ থেকে এই ধরনের আচরণ ক্রমশই আসতে থাকবে।

সি পি আই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গোরু বা হিন্দুত্ব উচ্চারণ করেছেন বলে তথ্যচিত্র বন্ধ হয়ে যাবে? এ কী করে সম্ভব? ওরা ঠিক করছে আমরা কী খাব, কী পরবো, কী বলব, কার সঙ্গে প্রেম করবো, কাকে বিয়ে করব; এখন ওরা ঠিক করতে চাইছে তথ্যচিত্রে কোন কথা আমরা শুনবো

অমর্ত্য সেনকে নিয়ে তথ্যচিত্রে এই বিতর্কের মধ্যেই সামনে এসেছে অনীক দত্তের ছবি ‘মেঘনাদবধ রহস্য’ নিয়ে আরো এক বিতর্ক। এই ছবির রিলিজ এক সপ্তাহ পিছিয়ে গিয়ে হচ্ছে ২১শে জুলাই। ছবির এক প্রযোজক সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, সেন্সর বোর্ড ‘রামরাজ্য’ শব্দ ব্যবহার আপত্তি জানিয়েছে। ‘রামরাজ্য’ শব্দটি বাংলায় নানা দ্যোতনায় ব্যবহার হয়। কিন্তু বি জে পি-রাজত্বে এখন এই শব্দের ব্যবহারও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছবির প্রযোজক-পরিচালকরা এ নিয়ে তেমন কোনও মন্তব্য না করলেও জানা গেছে, ‘রাম’ শব্দটি বাদ দেবার জন্যই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিচালকের আপত্তি থাকলে তাঁকে রিভিউ কমিটির কাছে আবেদন করতে হবে। সেই আবেদন করা হচ্ছে না বলেই এদিন জানা গেছে।

সেন্সর বোর্ডের মাথায় এখন পহলাজ নিহালনি। তিনি খোলাখুলি বি জে পি-র সমর্থক। একের পর এক ছবির ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থী, হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোর্ড আপত্তি জানিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবারই চিত্র পরিচালক প্রকাশ ঝা বলেছেন, নিহালনি ব্যক্তি হিসেবে কী করছেন, তা বড় কথা নয়। একটি মতাদর্শ পিছনে কাজ করছে।

অমর্ত্য সেন সম্পর্কে বি জে পি ও সঙ্ঘ পরিবারের মৌলিক আপত্তিই রয়েছে। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে দেশদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করে বি জে পি-র তরফ থেকে বিশেষ করে সোশ‌্যাল মিডিয়ায় লাগাতার প্রচার করা হয়ে থাকে।

Unforgettable Sudhirlal Chakraborty

May 11, 2017

অবিস্মরণীয় সুধীরলাল

সুরেন মুখোপাধ্যায়

কালের অনিবার্য নিয়মেই শতবর্ষে উপনীত হলেন শিল্পী ও সুরকার সুধীরলাল চক্রবর্তী। সুধীরলালের গান বাংলা কাব্যসংগীতের ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র ধারা। শতবর্ষের দূরত্ব থেকে আজ মনে হয় সুধীরলালের সংক্ষিপ্ত জীবনের গায়ন ও সুরনির্মাণ পদ্ধতি কতদূর বিস্তৃত। কতখানি স্বতন্ত্র ছিল তাঁর সংগীত শিক্ষা ও সংগীত ভাবনার পরিপ্রেক্ষিত। যুগ যায় যুগ আসে, সেই চলমান সুরপ্রবাহের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলাই ছিল তাঁর শিল্পী মনের মুখ্য বিষয়।সুধীরলালের গান যেন অনায়াস শ্বাসপ্রশ্বাস। যেন সরোবরে হংসসম সঞ্চরণ। তাঁর গাওয়া গান আধুনিকতার যান্ত্রিক কোলাহল পেরিয়ে হৃদয়ে শিকড়ের সন্ধানে পরিব্যাপ্ত থাকে। কথার অতলান্তে ডুবে ভাবের মুক্তো তুলে এনে কাব্য সংগীতের অনুপম মালা গেঁথে দেয়। তার এইসব মায়াবী গুণের জন্যই সুধীরলাল সামাজিক নানা ঝড়-তুফানের পরেও জন্মশতবর্ষে আজও অমলিন থাকেন এবং বাংলা গানের ইতিহাসে ভবিষ্যতেও উজ্জ্বল হয়েই থাকবেন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে একবার আমীর খাঁ বলেছিলেন — ‘আধুনিক ফাধুনিক বুঝি না। যে সুর লাগাতে জানে, যে গান সুরে ভরিয়ে দেয়, আনন্দ দেয় সেই তো প্রকৃত সংগীত। তুমি দু-ঘণ্টা ধরে কালোয়াতি করলে অথচ সুর লাগলো না, হৃদয়কে নাড়া দিল না, আনন্দ দিলো না। তাকে সংগীত বলি কী করে— কথাটা বড় সত্যি মনে হয় সুধীরলাল প্রসঙ্গে। তাঁর ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’, ‘ও তোর জীবনবীণা’, ‘খেলাঘর মোর ভেঙে গেছে’, ‘রজনী গো যেওনা চলে’, ‘গান গেয়ে মোর দিন কেটে যায়’, ‘তুমি ছিলে তাই ছিল গো লগন’, ‘প্রথম দিনের প্রথম সে পরিচয়’, ‘মিলনের গান তোমার আমার নয়’, ‘এ জীবনে মোর যত কিছু ব্যথা’ ইত্যাদি গান এখনও শ্রোতাদের মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে মায়াবী কণ্ঠ ও সুরের মোহজালে হৃদয় নাড়িয়ে মন ভরিয়ে দিতে পারে বলেই। দু-ঘণ্টা কালোয়াতি নয়, শুধু সাড়ে তিন মিনিট সময়েই শ্রোতাদের অবিষ্ট করে মাত করে দিতে পারেন সুধীরলাল চক্রবর্তী।

সুধীরলালের গানের গঠন-শৈলী একেবারেই লোকজ এবং ক্ল্যাসিকাল। প্রধানত ক্ল্যাসিকাল হলেও তাঁর গায়কী এবং সুরের বুনটের মধ্যে যে টানাপোড়েন তা উচ্চকিত নয়। রাগ-রাগিনীকে তিনি ভাবের নিরিখেই দেখেছেন। তিনি নিজে যখন ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’, ‘ও তোর জীবনবীণা’, ইত্যাদি গান গাইছেন তখন শ্রোতাদের মনে হচ্ছে কত অনায়াস, কত মধুর কত স্নিগ্ধ সে চলন। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে মার্গ সংগীতে অত্যন্ত দক্ষ হলেও তিনি তৎকালীন প্রবহমান সুরের শাস্ত্রীয় ধারা থেকে অনেকখানি সরে গিয়েছেন। কথার ভাবানুসারে সুর নির্মাণ ক্ষেত্রে তিনি রাগ-রাগিনীর মেদ ঝরিয়ে দিয়েছেন, ছোটো ছোটো দ্রুত তান বাদ দিয়েছেন। মিড় ছোটো করে হালকা মুড়কি দিয়েছেন, হরকৎ-ফিরৎ একেবারে বর্জন করেছেন। অর্থাৎ যতখানি স্বাভাবিক আবেগে উচ্চারণ করা যায় ততটাই রেখেছেন।

এ প্রসঙ্গে তাঁর সুরারোপিত তিনটি গানের উল্লেখ করি। একটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘শুধু অবহেলা দিয়ে বিদায় করেছ যারে’, দ্বিতীয়টি শ্যামল মিত্রের গাওয়া ‘শেষ কথা আজি বলে যাও’ এবং তৃতীয়টি উৎপলা সেনের গাওয়া ‘এক হাতে মোর পূজার থালা’। এইসব গানের সুর শুনলে কখনই মনে হবে না শুধু কথার ওপর রাগনির্ভর বৈশিষ্ট্যহীন সুর সৃজন। কথার সেন্টিমেন্ট অনুসারে জাত শিল্পীর পরিচয়েই রাগরাগিনী সুপ্ত রেখে সুধীরলাল সুর করে দিয়েছিলেন এবং গানগুলি তুলে দিয়েছিলেন কোন্‌ কণ্ঠবৈশিষ্ট্যে কোন্‌ গানটি উত্তীর্ণ হবে এটা বুঝেই। এইজন্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে খাড়া কাটা স্বরের প্রয়োগ কিন্তু শ্যামল মিত্রের ক্ষেত্রে লম্বা মিড়।

সুধীরলালের গানের আরও একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো তালকে সঙ্গে নিয়ে গান করা। শাস্ত্রীয় বিধিবদ্ধ তাল তার নিজের স্থানে ঠিকই আছে। কিন্তু আধুনিক গানে তাকে মাখিয়ে নিতে হয় গানের কথার সঙ্গে। সুরের সঙ্গে আপন যতিবোধকে সার্থকভাবে, সাংগীতিকভাবে স্থাপনা করতে হয়। সুধীরলাল তালকে তাঁর গানের নিজস্ব স্টাইলের সঙ্গে সহায়ক হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। বহু নামী শিল্পীকে দেখেছি তালের ব্যাপারে অকারণ সতর্কতা। আড়িতে গাইবার প্রবণতা, যা গানের অন্তর্নিহিত মাধুর্যকে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাহতও করেছে। কিন্তু সুধীরলালের গানের সঙ্গে তাল যেন বশংবদ অনুগামীর মতো চলেছে। নিজের সুরে গাওয়া ‘আঁখি তারে ভোলে যদি’, ‘ছাইল অম্বর ঘন মেঘে’ অথবা ‘কেন ডাক পিয়া পিয়া শুনলে’ বোঝা যাবে তালের সহজ ও সঠিক ব্যবহার গানকে কত মজিয়ে দিতে পারে।

সুধীরলাল চক্রবর্তী জানতেন মার্গ সংগীতের ভিত না থাকলে বিভিন্ন রকমের গান ভাল করে রসিয়ে গাওয়া কঠিন। ‘রজনী গো যেওনা চলে’ অথবা গজল প্রভাবান্বিত ‘বনভূমি শ্যামায়িত’, কাওয়ালি ছন্দ ও তালে ‘দোলানো কেন ডাক পিয়া পিয়া’ ইত্যাদি গানের মাধুর্য ফুটিয়ে তুলতে হলে গায়কীর যে মুনশিয়ানার দরকার তা তো তাঁর ছিলই, উপরন্তু এক গম্ভীর ন্যাজাল টোনের জাদু দিয়ে তিনি তৎকালীন গানের গতানুগতিকতার বেড়াটাকেই একেবারে ভেঙে দিয়েছিলেন। ওঁর গলার খাদের আওয়াজটা ছিল ভারী স্নিগ্ধ। তার সপ্তকে প্রবেশ করতো একটু ন্যাজাল টোন এবং দুয়ে মিলে পেথোজ বা বেদনাভরা আর্তি চমৎকার ফুটে উঠতো। ‘রজনী গো যেওনা চলে’ গানে ‘রজনী গো’ তার সপ্তকে বলে যেভাবে যেওনা চলে মধ্য সপ্তক দিয়ে অবরোহণে নেমে এসেছে, তাতে প্রাণস্পর্শী হয়ে উঠেছে বিদায় আসন্ন রজনীকে ধরে রাখার আকুল প্রয়াস। সুধীরলালের মতো দরদি শিল্পীর গান তাই একাধারে সমকালীন, সেই সঙ্গে সময়োত্তীর্ণ।

সুধীরলালের জন্ম ১৯১৬ সালে অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া পরগনার অন্তর্গত বালিয়াভাঙা গ্রামে। শৈশব থেকেই গানের প্রতি ছিল তাঁর সুতীব্র আকর্ষণ ও অনুরাগ। জন্মলব্ধ সুকণ্ঠের অধিকারী সুধীরলাল অনায়াসে গান তুলে তৎক্ষণাৎ গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিতে পারতেন। পিতা গঙ্গাধর চক্রবর্তীও ছিলেন সংগীত প্রিয় মানুষ। বাড়িতে গানের আসর মাঝে মাঝেই বসতো। একবার বহরমপুরে একটি আসরে গান গাইতে এসেছেন তৎকালের অন্যতম সংগীত নায়ক গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী। হাফ-প্যান্ট পরা সুধীরলাল মাত্র এগারো বছর বয়সে সেখানে উপস্থিত এবং শ্রোতাদের আদেশে প্রথমে একটি গান করলেন। সেই গান শুনে গিরিজাশঙ্কর মুগ্ধ, যিনি ছাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিলেন, যথেষ্ট সুর চেতনাসম্পন্ন না হলে সংগীত শেখাতেন না, সেই সংগীত নায়ক গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী নিজেই সুধীরলালকে সংগীত শিক্ষাদানে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আর গানের টানে সুধীরলাল কলকাতার গড়পাড়ে মামার বাড়িতে এসে উঠলেন। এইভাবেই গিরিজাশঙ্করের তত্ত্বাবধানে সুধীরলালের ধ্রুপদ ধামার খেয়াল, ঠুংরির ভাণ্ডার ক্রমশই সমৃদ্ধ হতে লাগলো।

নানা আসরে শিক্ষক গিরিজাশঙ্কর এই ছাত্রকে সংগীত পরিবেশনের জন্য পাঠাতেন এবং ছাত্রও সাফল্যের সঙ্গে সংগীত পরিবেশন করে আসতেন। ক্রমে মামাবাড়ি ছেড়ে গুরুগৃহে বসবাস এবং আপন প্রতিভা ও দক্ষতায় খেয়াল ঠুংরিতে অনন্য শিল্পী হয়ে ওঠেন। এলাহাবাদ মিউজিক কম্পিটিশন এবং বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনে সুধীরলাল অসাধারণ কৃতিত্বের নিদর্শন রাখেন এবং রেডিওতেও সংগীত পরিবেশনের সুযোগ পান। তখনও সুধীরলাল যৌবনে পা রাখেননি। তখন রেডিওতে লাইভ প্রোগ্রাম হতো। একবার রেডিওতে সকাল ৮-৩০ মিনিটে অনুষ্ঠান। সকাল সাড়ে সাতটার পরে সুধীরলাল এসে গুরুর কাছে বিলাসখানি টোড়ির ওপর বিখ্যাত গান ‘এ ছত্র নেহে সে যাই’ তুলে রেডিও-তে গাইলেন। গানের চলন এবং গান এত অপূর্ব হয়েছিল যে স্বয়ং গিরিজাশঙ্করও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। সুধীরলাল ক্রমেই বাংলার রাগসংগীত চর্চার ক্ষেত্রে একটি প্রিয় নাম হয়ে উঠলেন।

বেতারে নিয়মিত গান করতে করতেই ১৯৪৩ সালে তিনি ঢাকার বেতার কেন্দ্রের মিউজিক সেকশনের প্রডিউসার হিসাবে যোগদান করেন। এখানেই তিনি পেয়ে যান বন্ধু ও সংগীত জীবনের অন্যতম সুহৃদ পবিত্র মিত্রকে। প্রকৃতপক্ষে এখান থেকেই বাংলা গানের আরও একটি বাঁক এলো এই যুগলবন্দির মধ্য দিয়ে। যদিও সুধীরলাল চক্রবর্তীর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সা‍‌লে হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি থেকে দেবেশ বাগচীর কথায়। নিজের সুরে সুধীরলালের গাওয়া গান দুটি ছিল ‘ভালোবেসেছিনু আলেয়ারে’ এবং ‘রজনী গো যেওনা চলি’ গান দুটি প্রবল জনপ্রিয় হয়। ১৯৪৫ সালে গানের টানে কলকাতায় ফিরলেন সুধীরলাল এবং নিয়ে এলেন বন্ধু পবিত্র মিত্রকেও। পবিত্র মিত্রের কথা ও সুধীরলালের সুরে জোয়ার এলো। অজস্র কালজয়ী গান তৈরি হলো এই যুগলবন্দিতে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গান হলো ‘ওগো নয়নে আবীর দিও না’ শিল্পী নীতা বর্ধন, ‘যে দিন রব না আমি’ শিল্পী অনন্তদেব মুখোপাধ্যায়, ‘কার বাঁশি বাজে আজ’ শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ‘এ জীবনে মোর যত কিছু ব্যথা’ — শিল্পী সুধীরলাল, ‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায়’ শিল্পী সুধীরলাল, ‘তোমার আঁখির পরে’ শিল্পী সবিতা সিং ‘কেন মিছে ফিরে চাও’ শিল্পী গায়ত্রী বসু, ‘ঘুমায়ো না সহেলি গো’ শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ‌্যায়, ‘জীবনের পথে শুধু কেন’ শিল্পী উৎপলা সেন, ‘ওগো মোর গানের পাখি’ শিল্পী সুপ্রভা সরকার, ‘স্মৃতি তুমি বেদনার’ শিল্পী শ্যামল মিত্র, ‘শুধু অবহেলা দিয়ে বিদায় করেছ যারে’ শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ আরও অজস্র গান। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি গীত গজল, কাওয়ালি সমৃদ্ধ হলো তাঁর কণ্ঠ স্পর্শে। ছায়াছবির জগতে প্রথম সুর করেন ১৯৫০ সালে ‘গরবিনী’ ছবিতে। ১৯৫১ সালে ‘সুনন্দার বিয়ে’ এবং ‘জাগরণ’ এই দুটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন এরমধ্যে ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছবির গান প্রবল জনপ্রিয় হয়। ১৯৫২ সালের ২০শে এপ্রিল মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সের জীবনাবসান হয় সুধীরলাল চক্রবর্তীর।

শিক্ষক হিসাবেও অত্যন্ত সফল তিনি। তাঁর হাতে গড়া কিছু অসামান্য ছাত্রছাত্রী আছেন, যারা উত্তরকালে বাংলা গানের শ্রোতধারাটি সফলভাবে বহন করে নিয়ে গিয়েছেন, বাংলা গানের স্বর্ণযুগের যে মেলোডি, সুধীরলাল সঠিকভাবেই তাঁদের সে পথে পরিচালিত করেছেন। শ্যামল মিত্র, উৎপলা সেন, নীতা বর্ধন, গায়ত্রী বসু, অপরেশ লাহিড়ী তাঁর কৃতী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অন্যতম। একটি সাক্ষাৎকারে শ্যামল মিত্র একবার বলেছিলেন— ভালোভাবে সংগীতশিক্ষা আরম্ভ করি সুধীরলাল চক্রবর্তীর কাছে। সুধীরদা আজ নেই, কিন্তু আজ আমার যেটুকু সাফল্য আপনারা দেখছেন, এর মূলে ছিলেন সুধীরদা। আমাকে গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন এবং তাঁরই চেষ্টায় আমি রেকর্ড ও ফিল্মে গান করি। গান শেখাবার কালে গভীরভাব নিয়েই তিনি এমনভাবে ছাত্রছাত্রীদের শেখাতেন যাতে সুর তাল এসবের সঙ্গে গানের ভাবও হৃদয়ের মধ্যে গেঁথে যায়। আসলে গান ছিল সুধীরলালের মনের আশ্রয়। অনুভূতির অভিব্যক্তি ছিল তাতে আর ছিল সহজ আর্তি, কিন্তু ভাবালুতা নয়। এই অনুভূতির অনুকরণীয় প্রকাশভঙ্গি তিনি শিখিয়ে গেছেন নিজের ছাত্রছাত্রীদের।

সুরকার সুধীরলালের সুর নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল। ভারতীয় রাগসংগীতকে ভিত্তি করে আপন প্রতিভার জারক রসে নিজস্ব মিড়, মুড়কির স্পর্শে গানের বাণী ও ভাবকে ফুটিয়ে তুলতেন যথার্থ সুরশিল্পীর মতো। শিল্পীর কণ্ঠের গঠন অনুসারে গান তিনি এমনভাবে বাছতেন যাতে গানটি শেখাবার সময়েই সুর ও বাণীর যুগল সম্মিলনে গানটি অন্যতর আবেদন সৃষ্টি করে। প্রত্যেক শিল্পীর কণ্ঠে যে ভাল দিকটি থাকে গানটি শিল্পী কণ্ঠের সেই ভাল দিকের স্বরসংগতি স্বচ্ছন্দ খেয়াল রেখে গানটি তুলিয়ে দিতেন। ফলে শিল্পীর পক্ষে গান পরিবেশন করাটা অনায়াস হয়ে উঠতো। যে শিল্পীই সুধীরলালের সুরে গান গেয়েছেন সেই গান জনপ্রিয় তো হয়েছেই, শিল্পীও গানটি গেয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। অনন্তদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘যে দিন রবো না আমি’, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উছল তটিনী আমি’, ‘পান্না কাওয়ালের আমারে ভুলিতে’, উৎপলা সেনের ‘কেন জাগে শুকতারা’, অপরেশ লাহিড়ীর ‘সেই মালা দেওয়া নেওয়া’, গীতা দত্তের কণ্ঠে ‘বৃন্দাবনে শ‌্যাম নাই ফুলে মধু নাই’, গায়ত্রী বসুর ‘কেন এলে মধুরাতে’, এবং সুধীরলালের জীবনাবসানের পর শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে ‘স্মৃতি তুমি বেদনার’ শুধু গান হিসেবেই কালজয়ী হয়নি, শিল্পীদেরও এনে দিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য।

সুধীরলালের ভিতরে একটা কবি মন ছিল, তাই বিভিন্ন গীতিকারদের রচনাতে আপন কবিসত্ত্বার কারণে লিরিক অনুসারে যথাযথ সুরে সাজানোর ধ্যানকে যুক্ত করে রসোত্তীর্ণ ও কালজয়ী গান উপহার দিতে পেরেছেন। ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ অথবা ‘স্মৃতি তুমি বেদনার’ মতো গানে কথার যে অন্তর্মুখীনতা, যে আত্মনিবেদনের মাধুর্য, তার গভীরে প্রবেশ করতে না পারলে এই সুর করা একেবারেই অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন বাংলার সুর কথাকে খোঁজে। সে যুগল মিলনের পক্ষপাতী একের যোগেই অন্যটি সার্থক। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত শিক্ষার ঔজ্জ্বল্যের জন্যই ভাবনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে এমন মন কেমনের দোলা জাগানো সুরে সুধীরলাল গানগুলিকে বাঁধতে পেরেছিলেন। এইসব গান যেমন কাব্যধর্মীতায় সমৃদ্ধ তেমনি সুরের আভিজাত্যে উজ্জ্বল। আমাদের অতি পুরাতন অতি প্রিয় রাগও যেন নবরূপে সেজে সুধীরলালের হাত ধরে বিচিত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটাই সুরকার সুধীরলালের বিশেষত্ব। শিল্পী ও গবেষক ড. অনুপ ঘোষাল সুধীরলাল সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন — ‘রাগসংগীত ভেঙে সুধীরলাল যে সমস্ত সুর রচনা করেছিলেন বাংলা এবং হিন্দিতে সে সব গানে ছিল এক অনিন্দ্য সুন্দর মেলোডি, অপূর্ব স্বাদ। সংগীত প্রেমিক বাঙালির কাছে তা ছিল অভূতপূর্ব। সুরসাগর হিমাংশু দত্তের পর সুধীরলাল চক্রবর্তী হলেন বাংলার আরেক ব্যক্তিত্বময় সুরস্রষ্টা যিনি ক্ষণিক সময়ের জন্য এ জগতে অবস্থান করলেও কর্মের ঔজ্জ্বল্য দিয়ে বাংলা গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।

সুধীরলাল যখন গানের ক্ষেত্রে এলেন তখন বাংলায় সংগীত প্রতিভা বড় কম ছিল না। কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন, পঙ্কজকুমার মল্লিক ছিলেন। ছিলেন শচীনদেব বর্মণ, ছিলেন জগন্ময় মিত্র। কিন্তু গায়কের আবেগ, গলার মাদকতা, স্বরক্ষেপণ, বিশুদ্ধ উচ্চারণ এবং কথা ও সুরের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নেওয়ার অনন্য ক্ষমতায় সুধীরলাল তখনই অন্যদের চেয়ে অনেকটাই স্বতন্ত্র। সংগীত বোধের চমৎকারিত্বে অনেকটাই আলাদা। আসলে কথা ও সুরের ওপর ব্যক্তি অনুভূতি আবেগের এমন পাতলা এক আস্তরণ তাঁর গানে মিশে আছে যে এই অনুভূতির আঘ্রাণে আন্তরিকতায় তিনি অন্যদের থেকে নিজেকে ব্যতিক্রমী করেছেন। যার জন্যে ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’, ‘খেলাঘর মোর ভেঙে গেছে’, ‘এ জীবনে মোর যতকিছু ব্যথা’, ‘ভালোবেসে ছিনু’ ইত্যাদি বিষাদঘন গানগুলি আজও হৃদয়ে বুলিয়ে দেয় স্নিগ্ধ চন্দনের প্রলেপ। আর এখানেই সুধীরলাল ট্রেন্ডসেটার, বাংলা গানের মাইল-ফলক। নিজের সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকার মানসিকতার দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে তাঁর গান ও সুরের সর্বত্র। তিনটি সপ্তক জুড়ে সুরের বিচরণ কিন্তু আশ্চর্য স্নিগ্ধ; জটিল সুর বিন্যাস কিন্তু আশ্চর্য আবেগঘন, নির্লিপ্ত। আমাদের রুচিবোধ গড়ে দেওয়ার, তৃপ্তি দেওয়ার মহার্ঘ্য সম্ভার নিয়ে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছেন তিনি। বিশেষত এই মূল্যবোধহীন, সুরের নামে অস্থির সময়ে নিরাসক্ত বাউল সুধীরলাল বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে আমাদের কাছে আসেন। তিনি বাংলা গানের এক চিরকালীন নস্টালজিয়া।


   সৌজন্যেঃ গণশক্তি

US Missile Attack On Syrian Airbase

April 10, 2017

CPI(M)’s Income From ‘Unknown Sources’

February 3, 2017

লক্ষ লক্ষ মানুষের সাহায্যই আমাদের ‘অজানা উৎস’

অভীক দত্ত

বছরখানেক আগে কাঁচড়াপাড়ায় সি পি আই (এম)-র এক কর্মী নিজের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচ বাঁচিয়ে ২৫হাজার টাকা পার্টির জন্য দান করেছেন। অবসর গ্রহণের পরে বারাসতের এক রেলকর্মী প্রাপ্ত টাকা থেকে ২৫হাজার টাকা সাহায্য করেছেন। কলকাতায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মৃদুলা ঘোষ কদিন আগেই তাঁর প্রয়াত কন্যা সুরঞ্জনা ভট্টাচার্যের স্মৃতিতে ২লক্ষ টাকা দিয়ে গেছেন। উদাহরণ এরকম অজস্র রয়েছে। কেউ নিজের পি এফ গ্র্যাচুইটির টাকা হাতে পেয়ে দান করেছেন, কেউ মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ স্মৃতি পুরস্কার পেয়ে সেই অর্থ পার্টি তহবিলে দিয়েছেন, কেউ বা নিজের সারাজীবনের সঞ্চয় পার্টিকে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বামপন্থী আন্দোলনের জন্য সাহায্যের এমন অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। টাকার অঙ্ক বড় কথা নয়, কিন্তু মানুষের সাহায্য কী শক্তিধর হতে পারে তা যারা গ্রহণ করে তারাই টের পায়। টাকা আর মানুষের শুভকামনা এখানে একাকার হয়ে মিলেমিশে আমাদের শক্তি দিয়েছে। সি পি আই (এম) তার সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনার জন্য মানুষের কাছ থেকে এভাবেই অর্থসাহায্য পেয়ে থাকে।কিন্তু কিছু সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত প্রচার করা হচ্ছে, অন্য সব রাজনৈতিক দলের মতো সি পি আই (এম)-র আয়ও রহস্যময়, অস্বচ্ছ। সি পি আই (এম)-রও আয়ের বেশিরভাগই নাকি ‘অজানা উৎস’ থেকে। এক কথায় ভূতুড়ে। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, এই রাজনৈতিক চৌর্যবৃত্তির রমরমা বাজারে সি পি আই (এম)-র গায়েও কালির ছিটে লাগানো। বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, দুর্নীতিতে সব রাজনৈতিক দলই সমান। মুড়ি আর মিছরি এক করে দেখানোর চেষ্টা।

সম্প্রতি দু-একটি সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে, ‘‘২০০৪-’০৫ থেকে ২০১৪-’১৫। এই ১১ বছরে দেশের রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে মোট ১১,৩৬৭ কোটি টাকা চাঁদা জমা পড়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই চাঁদার উৎস কী, তা কেউ জানে না।’’ অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এ ডি আর) নামের একটি সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্ট উদ্ধৃত করে ঐ সংবাদে অজানা উৎস থেকে আয়ের ক্ষেত্রে বি জে পি, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে সি পি আই (এম)-রও নাম উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, এই ১১ বছরে সি পি আই (এম)-র মোট আয় প্রায় ৮৯৩ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৪৭১.১৫ কোটি টাকা ‘অজানা উৎস থেকে’।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে সি পি আই (এম)-র আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রায় প্রতি বছরের একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগেও কিছু সংবাদমাধ্যম সি পি আই (এম)-র আয়ের উৎস নিয়ে অপপ্রচার করেছে। কিছু আর্থিক পরিসংখ্যানকে তারা ‘অজানা উৎস’ জাতীয় তকমা লাগিয়ে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে এই অপপ্রচার সেরেছে এবং অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সি পি আই (এম)-কে এক পঙ্‌ক্তিতে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অন্য কোনো রাজনৈতিক দল তাদের আয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমের তোলা প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে না, বরং এড়িয়ে যায়। কিন্তু সি পি আই (এম) প্রতিবারই নিজেদের আয়ের উৎস ব্যাখ্যা করে জোরের সঙ্গে এর জবাব দিয়েছে, যদিও সংবাদমাধ্যমগুলি কখনোই সেই জবাব উল্লেখ করার সৌজন্যটুকুও দেখায় না।

অথচ আয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে সি পি আই (এম) রীতিমতো গর্ববোধ করতে পারে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলি যে প্রশ্নে অস্বস্তিতে কুঁকড়ে যেতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তরে সি পি আই (এম) গর্বের সঙ্গে বলতে পারে, আমরা কোনো পুঁজিপতি বা কর্পোরেট সংস্থার থেকে টাকা নিয়ে চলি না। সি পি আই (এম) তার সদস্যদের দেওয়া লেভি এবং শ্রমজীবী জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত টাকায় পার্টি ও পার্টির সংগ্রামের কর্মসূচি পরিচালনা করে। রাজনৈতিক দলগুলিকে স্বচ্ছভাবে অনুদান দেওয়ার প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে টাটা শিল্পগোষ্ঠী একবার জাতীয়স্তরে স্বীকৃত প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে চাঁদা হিসাবে চেক পাঠিয়েছিল। দিল্লিতে সি পি আই (এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর এ কে গোপালন ভবনেও সেই চেক এসেছিল। কিন্তু সি পি আই (এম)-ই একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা নিজেদের অপারগতার কথা জানিয়ে সেই চেক টাটাদের ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। অন্য কোনো জাতীয় দল এই বলিষ্ঠতা দেখাতে পেরেছে? জনগণের সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কেবলমাত্র জনগণের অর্থের ওপরেই নির্ভরশীলতায় বিশ্বাসী সি পি আই (এম)। এটা যদি গর্বের না হয় তবে রাজনীতিতে গর্বের আর কি থাকতে পারে!

অন্য রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের উৎসের সঙ্গে সি পি আই (এম)-র আয়ের উৎসের মিল খুঁজতে গেলে গোড়াতেই হোঁচট খাওয়াটা অবশ্য স্বাভাবিক। একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের প্রতিমাসে নিয়মিত লেভি দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। পার্টির গঠনতন্ত্রের ১০নং ধারায় স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে কোনো ব্যক্তিকে সি পি আই (এম)-র সদস্য থাকতে গেলে তাঁকে পার্টির দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সঙ্গে সঙ্গে আয় অনুসারে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি নির্ধারিত হারে প্রতি মাসে লেভি দিতে হবে। পরপর তিন মাস কোনো কারণ ছাড়া কেউ লেভি জমা না দিলে এমনকি তাঁর সদস্যপদও খারিজ হয়ে যেতে পারে। সি পি আই (এম) গঠিত হওয়ার পরে ছয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমবঙ্গে পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল ১১হাজারের মতো। এখন পার্টি সদস্যের সংখ্যা আড়াই লক্ষের কাছাকাছি। বিভিন্ন আয়ের পার্টি সদস্য রয়েছেন। ৫০০০ টাকা আয় করেন এমন সদস্যও ন্যূনতম ২৫ টাকা লেভি দেন প্রতি মাসে। প্রতিটি পার্টি সদস্যকে প্রতি মাসের লেভি এবং প্রতিবছর সদস্যপদ পুনর্নবীকরণের জন্য ৫টাকা করে জমা দিতে হয়। যে-কোনো কমিউনিস্ট পার্টির মতই সি পি আই (এম)-র আয়ের মূল উৎস পার্টি সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া এই লেভি। গণসংগ্রহ প্রত্যেক পার্টি সদস্যের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ও শৃঙ্খলা। মোট সংগ্রহের ৭০ভাগই আসে ক্ষুদ্র সংগ্রহ থেকে।

লেভি ছাড়াও মাঝে মাঝেই পার্টির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে বিশেষ তহবিলের ডাক দেওয়া হয়। তাতেও কখনো এক দিনের আয় অথবা অর্ধেক দিনের আয় পার্টি সদস্যদের পার্টি তহবিলে জমা দিতে হয়। তাছাড়া, পার্টির প্রতীকে নির্বাচিত সাংসদ, বিধায়ক বা জনপ্রতিনিধিদের প্রাপ্য সরকারি বেতন বা ভাতার টাকাও সাধারণভাবে পার্টির তহবিলেই জমা দিতে হয়। এমনকি, অবসরপ্রাপ্ত সাংসদ বা বিধায়করা পেনশন বাবদ যে টাকা পান, তারও সবটা বা অধিকাংশ টাকাই পার্টি তহবিলে জমা পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্য দলে এমন প্রক্রিয়ার কথা কেউ ভাবতে পারে? ভাবুন, সমর মুখার্জি, নীরেন ঘোষ এবং অনেক আত্মোৎসর্গী সাংসদ নেতার কথা, যাদের এক টাকাও সঞ্চয় ছিল না। অন্য কোন দলে এমন দৃষ্টান্ত আছে! প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মানুষের সাহায্যে গণ-অর্থসংগ্রহে সাড়া পায় আমাদের পার্টি।

এর চাইতে এমন ভাবা এবং ভাবানো হয়তো অনেক সহজ যে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে টাকা সংগ্রহ করে উৎস গোপন করে থাকে, সেভাবেই উৎস গোপন করে আয় করছে সি পি আই (এম)।

কিন্তু আয়কর আইন এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী ২০হাজার টাকার বেশি অঙ্কের অর্থদাতাদের নাম জানাতে বাধ্য যে-কোনো রাজনৈতিক দল। সি পি আই (এম) এই অর্থদাতাদের নাম নিয়মিতভাবে নির্বাচন কমিশন এবং আয়কর দপ্তরকে জানিয়ে আসছে আইন মেনে। যদিও সি পি আই (এম)-র মোট আয়ের মাত্র ১শতাংশেরও মতো আসে এমন অর্থদাতাদের দান থেকে। মুখ্য আয় হয়ে থাকে, পার্টি সদস্যদের লেভি (৪০শতাংশের মতো) এবং গণসংগ্রহ থেকে। কমিউনিস্ট পার্টির ভাণ্ডার প্রকৃত অর্থেই রয়েছে গরিবের ঘরে ঘরে। অসংখ্য গরিব মানুষ পার্টির সংগ্রামকে নিজেদের সংগ্রাম মনে করে দশটাকা বিশ টাকা করে দান করে থাকেন। বহু গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের সাহায্য এবং কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি দৃঢ় সমর্থন থেকে কিছু সচ্ছল মানুষের নিজেদের সর্বস্ব দেওয়ার অজস্র নজির এরাজ্যে রয়েছে। ২০১৫ সালের ৬ই আগস্টের সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের জন্মদিন উপলক্ষ সভার মঞ্চে এক সদ্য পুত্রহারা বৃদ্ধা জননী ২লক্ষ টাকা তুলে দিচ্ছেন সূর্য মিশ্র এবং বিমান বসুর হাতে।

জেলায় জেলায় সি পি আই (এম)-র অজস্র পার্টি দপ্তর এবং স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে যা গড়ে উঠেছে পার্টি নিবেদিত প্রাণ কোনো ব্যক্তির দান করা জমি অথবা বাড়িতে। এই সমস্ত আয় এবং সম্পদ এসেছে অন্য দলের মতোই ‘অজানা উৎস’ থেকে বলে দেওয়ার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। কমরেড সরোজ মুখোপাধ্যায়ের কথায় ‘এলাকার প্রতিটি মানুষের কাছে পার্টির অর্থের প্রয়োজনের কথা বোঝাতে হবে। কি কি কাজে টাকা খরচ হয় তা সাধারণভাবে তাঁদের বোঝাতে হবে’। শ্রমিকশ্রেণির পার্টি গরিবের পার্টি হলেও এ পার্টির ভাণ্ডার অফুরন্ত। এজন্য শত আক্রমণেও এই পার্টি ভেঙে পড়ে না। কারণ শ্রমজীবী জনগণের সংখ্যা শোষক শ্রেণির জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। প্রত্যেকে দশ টাকা বা পাঁচ টাকা করে দিলেও লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অর্থসংগ্রহ সম্ভব, কমরেড সরোজ মুখোপাধ্যায়ের শেখানো পথ এলাকায় এলাকায় আমরা অনুসরণ করে চলেছি।

খনি অথবা স্পেকট্রামের বরাত দিতে মন্ত্রীদের যখন ঘুষ নিতে দেখা গেছে, আম্বানি আদানিদের টাকায় যখন রাজনৈতিক দলের রমরমা চলছে, যখন মানুষ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন চিট ফান্ডের টাকা লুটে একটি রাজনৈতিক দল দাপটের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে সরকার চালাচ্ছে, চোখের সামনে টেলিভিশনের পর্দায় ঘুষ নিতে দেখা যাচ্ছে শাসকদলের মন্ত্রী সাংসদদের, তখন রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোন্‌ মনোভাব তৈরি হচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।সর্বশেষ সাধারণ বাজেটে মোদী সরকার রাজনৈতিক দলকে ২হাজার টাকার বেশি নগদে অনুদান দেওয়া যাবে না বলে যে ঘোষণা করেছে সেটা নেহাতই মানুষের চোখে ধুলো দেওয়া ছাড়া কিছু নয়। নয়া উদারনীতির যুগে নির্বাচনে সীমাহীন অর্থশক্তি ও কালো টাকার ব্যবহার, মাফিয়াদের পেশিশক্তি, রাজনীতির অপরাধীকরণ জনগণের অধিকারকে প্রহসনে পরিণত করছে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের সামনে গুরুতর বিপদ তৈরি করছে। তা ঠেকানোর কোনো প্রচেষ্টা সরকারের তরফে দেখা যাচ্ছে না। একমাত্র বামপন্থীরাই এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির কাজ ছাড়াও আমূল নির্বাচনী সংস্কারের দাবি করেছে।

সি পি আই (এম) চায় রাজনৈতিক দলকে কর্পোরেটের দান সবদিক থেকে নিষিদ্ধ করা হোক। তার পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় তহবিল তৈরি করে নির্বাচনে ব্যবহার করা হোক। যাতে টাকা নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলকে কর্পোরেটের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে না হয়।এই জটিল পরিস্থিতিতে দুর্নীতির মূলে থাকা রাজনৈতিক অর্থনীতিকে চিনিয়ে দেওয়াটাই জনগণের কাছে প্রয়োজনীয় ছিলো। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি আর বামপন্থী রাজনীতির ফারাকটা আরও স্পষ্টভাবে চেনানোর দরকার ছিলো। কিন্তু সংবাদমাধ্যম করছে তার উলটোটাই। তারা সাধারণভাবে সমগ্র রাজনীতিকেই চুরির দায়ে কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা করছে, সাদা-কালো মিশিয়ে দিচ্ছে, ভিন্নধরনের প্রক্রিয়ায় আয় সংগ্রহ করা রাজনৈতিক দল সি পি আই (এম)-কে এক পঙ্‌ক্তিতে বসাচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে ‘সবাই সমান’ বলে বিরাজনীতির স্রোত তৈরির চেষ্টা করছে

এমন অপচেষ্টা রাজনীতিতে দুর্নীতি বন্ধ করতে সাহায্য করবে না, বরং ‘সবাই সমান’ রটনার আড়ালে প্রকৃত দুর্নীতিগ্রস্তদের পার পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেবে।

এই লেখা শেষ করবো, গান্ধীজীকে লেখা পি সি যোশীর একটি চিঠির অংশ উল্লেখ করে। একদল কমিউনিস্ট-বিদ্বেষীর কাছ থেকে ক্রমাগত কুৎসা শুনে ১৯৪৪ সালে গান্ধীজী কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আপনাদের পার্টির আয় ব্যয়ের হিসাব কি আমি দেখতে পারি?’ সশ্রদ্ধ নম্রতা নিয়ে যোশী তাঁকে ইতিবাচক জবাবই দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে আরেকটি অনুরোধ করেছিলেন। যোশী লিখেছিলেন, ‘আমি আপনাকে আরেকটি পালটা অনুরোধ করার লোভ সামলাতে পারছি না। আমি যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবো আপনি আপনার একজন প্রতিনিধি পাঠাবেন। তিনি দেখতে পাবেন, আমাদের পার্টির কথা শুনতে কীভাবে দশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার মানুষ বের হয়ে আসছেন। তাঁদের উৎসাহ উদ্দীপনা আপনাকে ১৯২০ সালের দিনগুলির কথা মনে পড়িয়ে দেবে। সবশেষে আমি তাঁদের কাছে পার্টি তহবিলে দান করার জন্য অনুরোধ করবো। হাজার হাজার মানুষ কীভাবে দান করছেন তা দেখে আপনার প্রতিনিধির চোখে জল চলে আসবে।’

আজকে যারা সি পি আই (এম)-র আয়ের ‘অজানা উৎস’ সন্ধান করতে চাইছেন, তাঁদেরকেও যোশীর মতোই পালটা অনুরোধ করতে ইচ্ছা করে। গর্ব করে বলতে পারি, দেখতে পাবেন সেই ঐতিহ্য সি পি আই (এম) রক্ষা করেই চলেছে। তবে মোদী বা মমতার দেওয়া চশমাটা খুলে আসবেন। খোলা চোখে দেখলে আপনার কাছে ‘অজানা’ তথ্য জানা হয়ে যাবে।

আমরা বিশ্বাস করি, শ্রেণিশত্রুর আক্রমণের ফলে কমিউনিস্ট পার্টি কোনদিন দুর্বল হয় না। আরো শক্তিশালী হয়। আরো পরিণত, সুদৃঢ় পার্টিতে পরিণত হয়। সেই আক্রমণের মধ্য দিয়েই আমরা পথ হাঁটছি।


   সৌজন্যেঃ গণশক্তি

Politics of Cashless Economy

December 29, 2016

নগদহীন ব্যবস্থার অর্থনীতি

মানব মুখার্জি

২০১৬-র ৮ই নভেম্বরের প্রায় মধ্যরাতের ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল বলে ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কেন এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক—এরও কারণ তিনি বলেছিলেন। আর পাঁচজন আর এস এস নেতার মতই তিনি সচরাচর সত্য ভাষণ করেন না। এক্ষেত্রেও করেননি — বললেন ‘পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য এ কাজ করেছেন’। পরে বললেন, ‘সন্ত্রাসবাদীদের আঘাত করতে এই কাজ করেছেন’। বাজারে এখন পাকিস্তান বা সন্ত্রাসবাদ বিরোধিতার কথা ভালো ‘খায়’ তাই প্রথমে এটা। দেশের মানুষ কিন্তু এটা খেলো না। তারপর বললেন কালো টাকা উদ্ধার করার জন্য এটা করেছেন। যেটা কিছুটা হলেও মানুষ খাচ্ছে। কারণ দেশের অর্থনীতিতে কালো টাকা একটা বাস্তব বিষয়। চোখের সামনে বেআইনি বড়লোকী দেখে মানুষ যারপর নাই ক্ষুব্ধ। কিন্তু প্রশাসক হিসাবে তার এবং তার সরকারের অপদার্থতা গোটা বিষয়টাকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে।

নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত দেশের ১৩০কোটি মানুষের ওপর একটি অর্থনৈতিক পারমাণবিক বোমার মতো ফেটে পড়েছে। গোটা অর্থনীতি বিপর্যস্ত। স্বাধীন ভারতবর্ষে এতবড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় আর কখনও হয়নি। আর ক্ষয়ক্ষতির একটা বড় অংশের মেরামতিও হবে না। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী তার গোটা সরকার এবং অনুগত কর্পোরেট এবং তাদের মিডিয়া সমস্বরে বলছে আসলে এর মাধ্যমে আমরা নাকি মুদ্রাহীন অর্থনৈতিক (Cashless Economy) ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি। অবশেষে আমরা আধুনিকতার দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

এই সমস্ত দাবি-পালটা দাবি, রাজনৈতিক কোলাহল ছেড়ে আমাদের বোঝা দরকার — আসলে নোট বাতিলের মধ্যে দিয়ে কি হলো। সরকার আসলে দেশের সমস্ত মানুষের কাছে যা নগদ টাকা ছিল সেই টাকা তুলে নিল। ব্যাঙ্কেই তা জমা পড়ল, কিন্তু মানুষ চাইলেই সেই গোটা টাকাটা নিজের হাতে ফিরিয়ে নিতে পারছে না। যেহেতু ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোটে দেশের মোট টাকার ৮৬%, কাজেই বলা যায় টাকার সিংহভাগ এখন ব্যাঙ্কের হাতে, মানুষের হাতে না। যে টাকাটা এলো, এর মধ্যে একটা অংশ কালো টাকা, তবে সেটা খুব ছোট অংশ। কারণ টাকাতে কালো টাকা রাখা হয় খুব কম। কালো টাকা জমি-সোনা-বাড়ি এই সব কিছুতে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। নানাভাবে কালো টাকা বিদেশে চলে যায়, রূপান্তরিত হয় বিদেশি মুদ্রায় যা আমাদের সরকারের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আবার রূপান্তরিত বিদেশি মুদ্রা বিদেশি বিনিয়োগ হিসাবে দেশে ফিরে আসে। অসংখ্য সংস্থা আছে যারা সরকারের নজর এড়িয়ে কালো টাকাকে সাদা করে দেয় যাকে ইংরেজিতে বলে Money Laundering.

কাজেই কালো টাকা-ঠাকা নয়, এর মধ্য দিয়ে সরকার দেশের সমস্ত জমা নগদ ব্যাঙ্কজাত করে দিল। এখানেই সরকারের শেষ দাবিটিকে প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে — আমরা মুদ্রাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যাওয়ার চেষ্টা করছি।

আসলে মুদ্রাহীন ব্যবস্থার মানে কি? ক্রেতার কাছে কোনো নগদ টাকা থাকবে না। সে কার্ডের (ডেবিট বা ক্রেডিট) মাধ্যমে জিনিস কিনবে। এমনকি ইন্টারনেট সংবলিত একটি মোবাইল ফোন থাকলেই (যেমন পে টি এম) সে জিনিস কিনতে পারবে। নোটের কোনো দরকার থাকবে না। এটা ইতিমধ্যেই আমাদের দেশে আছে। এই যে নগদহীন দেড় মাসে ভারতবর্ষের বড়লোক এমনকি মধ্যবিত্তদের একটা অংশেরও খুব একটা অসুবিধা হয়নি এর জন্য। এ দেড় মাসে বাকি সব কিছুর চাহিদা কমেছে বেড়েছে কেবল কার্ড এবং পে টি এমের। নগদহীন অর্থনীতির মানে পরিমাণটা বাড়ানো।

আমাদের দেশে যত খুচরো লেনদেন হয় তার শতকরা ৯৮% হলো নগদে, আর লেনদেনের টাকার পরিমাণের ৭০% হলো নগদ টাকা। নগদহীন অর্থনীতি মানে এই পরিমাণটাকে দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে। এই গোটা কাণ্ডটি ঘটানোর জন্য যে কার্ড দরকার আমাদের দেশের সেই কার্ডের মোট সংখ্যা ৭৫ কোটি। কিন্তু কার্ডের মালিকের সংখ্যা এর ধারে কাছেও না। কারণ কার্ডের মালিকদের অধিকাংশরই একাধিক কার্ড। একাধিক ব্যাঙ্কের এবং ডেবিট এবং ক্রেডিট উভয় ধরনের। (ডেবিট কার্ড হলো ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে একজনের যত টাকা থাকে সর্বাধিক প্রায় সেই পরিমাণের টাকা সে কার্ডের মাধ্যমে খরচ করতে পারবে। ক্রেডিট কার্ডে ব্যবহার করা যায় ব্যাঙ্কে এক পয়সাও না থাকলে। একটি সর্বচ্চোসীমা কার্ড কোম্পানি নির্দিষ্ট করে দেয়। এই পরিমাণের টাকা এই কার্ডের মাধ্যমে একজন খরচ করতে পারে এবং নির্দিষ্ট তারিখে প্রতি মাসে সে যত টাকা নিয়েছে সেই টাকা শোধ করতে হয়। শোধ না করলে বিপুল পরিমাণের সুদ দিতে হয়। তবে দু’ধরনের কার্ডেই প্রতি কেনাকাটায় একটি সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। বছরে একবার কার্ডটিকে রিনিউ করতে হয় টাকা দিয়ে) আপাতত আমাদের ঘোষিত লক্ষ্য দেশের অধিকাংশ মানুষকে কার্ড সংবলিত করতে হবে।

মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চলে পে টি এম। আগেই সেখানে টাকা রাখতে হয় ব্যাঙ্ক থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। তারপর মোবাইল ফোন থেকে টাকা দিতে হয়। এছাড়াও একটি আধা নগদহীন ব্যবস্থা আছে, সেটা বেশ চালু পদ্ধতি। আমার পকেটে টাকা থাকবে না, কিন্তু কোনো একটি জিনিস কিনতে গেলে এ টি এম (Automated Teller Machine) কার্ড দিয়ে সেই পরিমাণ টাকা এ টি এম থেকে তুলে নিয়ে কিনে নাও। কিন্তু এর প্রতিটি আম-ভারতীয়র ক্ষমতার বাইরে। আমাদের দেশের মতো বিশাল একটি দেশে এ টি এম-এর সংখ্যা মাত্র ২.৩লক্ষ। কার্ড ব্যবহার করতে হলে বিক্রেতার কাছে নেট সংবলিত একটি টার্মিনাল থাকতে হবে। এরকম যন্ত্র এই মুহূর্তে দেশে আছে মাত্র ১৪ লাখ দোকানে। আর পে টি এম-এর ক্ষেত্রে ক্রেতা এবং বিক্রেতা দু’জনের কাছেই অন্তত ৩জি নেটওয়ার্ক সংবলিত স্মার্টফোন থাকতে হবে।

কবে ১৩০কোটির দেশ নগদহীন হবে? জনসংখ্যার তুলনায় এই ব্যবস্থা আমাদের দেশে খুব দুর্বল, এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা একটি দেশের মধ্যে পড়ি আমরা। আর এর থেকেও বড় পরিকাঠামোগত সমস্যা তো আছেই। দেশের কত অংশে নেটওয়ার্ট আছে? দেশে টেলিফোন ব্যবহার করতে পারে কত মানুষ? ৫১% গ্রামে টেলিফোন নেই। লেখাপড়া জানে না কত জন? প্রায় ৩০কোটি। ইংরেজি পড়তে পারে কত অংশ? ২০%। দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে কত অংশের মানুষ? ২৭কোটি। ২৩.৩ কোটি মানুষের কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই। এর মধ্যে ৪৩% ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কোনদিন কোনো লেনদেন হয় না। কার্ড বা এ‍‌ টি এম বা স্মার্টফোনের সংখ্যা যা, তাও প্রধানত শহরাঞ্চলে — বিস্তীর্ণ গ্রাম প্রায় মরুভূমি। তবে কি করে আমরা নগদহীন হব?

একটি নগদহীন অর্থনীতি করা যায় বা করার প্রয়োজন এরকম কথা দু’দিন আগেও দেশের সাধারণ মানুষ ভাবেনি। এগুলো আমরা নতুন শুনছি। আমরা জানছি সুইডেনই নাকি পৃথিবীতে প্রথম নগদহীন দেশ হবে। আমরাও খোঁজ নেবার চেষ্টা করছি — কি করে সুইডেন এরকম হলো? এবং বুঝবার চেষ্টা করছি আমরা কি করে সুইডেন হব? সুইডেন মাথা পিছু আয়ে পৃথিবীর সব চেয়ে বড়লোক একটি দেশের মধ্যে পড়ে। মানব উন্নয়ন সূচকেও সুইডেন প্রথম সারিতে। সুইডেনের সরকার ঘোষণা করেই নগদহীন অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে। অবশ্য এর মানে এই না যে সুইডেনে নগদ টাকার কোনো ব্যবহার নেই। সুইডেনের ৫৯% বেচাকেনা হয় নগদ ছাড়া। এ প্রশ্নে সর্বোচ্চ জায়গায় আছে সিঙ্গাপুর ৬১%। আমাদের দেশে এটা মাত্র ২%। কিন্তু এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা ভালো এটা প্রধানত খুচরো বিক্রি। দেশের বড় ব্যবসা বাণিজ্যের একটা বড় অংশ চিরকালই নগদহীন। টাটা স্টিল যখন ইন্ডিয়ান অয়েল থেকে জ্বালানি কেনে বা আম্বানিরা রেলের মাধ্যমে মাল পাঠালে নগদে রেলকে ভাড়া দি‍‌তে হয় না। সেটা সরাসরি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে হয়। যত সমস্যা সাধারণ ক্রেতার। গোটা পৃথিবীতেই এটা নিয়ম।

সরকার বলছে বলেই সুইডেনে সবাই নগদহীন পথে যাচ্ছে তা না। যদি টেকনোলজি জানা থাকে তবে এটি খুবই সুবিধার। কোন টাকা পয়সা সঙ্গে রাখার দরকার নেই, চুরি ছিনতাই, পকেটমারের দুশ্চিন্তা নেই। এখনও সুইডেনে নগদ চলে দূরবর্তী গ্রামীণ অঞ্চলে এবং বয়স্ক যারা নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করতে পারে না তারা নগদ ব্যবহার করে। এটাও কমে আসছে। সুইডেনের ব্যাঙ্কগুলো তাদের এ টি এম-গুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান এখন নগদ নেয় না।

কিন্তু এখানেই শেষ না। উন্নত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ব্যাঙ্কে সুদের হার চিরকালই খুব কম। এখন সেই সুদের হারকে ঋণাত্মক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তুমি ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে তোমাকে ব্যাঙ্ক কোনো সুদ দেবে না। বরং তোমার টাকা রে‍‌খেছে বলে ব্যাঙ্ক ‍‌তোমার টাকা কাটবে। তোমার জমা রাখা টাকা প্রতি বছরে কমবে। এই ঘটনা প্রধানত ঘটছে উন্নত পুঁজিবাদী দেশে বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে। এবং দেখা যাচ্ছে যে, যত Cash Less তত তার সুদের হার কম। এই বছরের আগস্ট মাসের হিসাব অনুযায়ী ঋণাত্মক সুদের হার — ডেনমার্ক -০.৬৫%, জাপান, -০.১০%, সুইজারল্যান্ড -০.৭৪%, সুইডেন -০.৫০%। যে সমস্ত দেশে নগদহীন অর্থনীতির প্রসার বেশি হয়েছে সেখানে ব্যাঙ্কের সুদ কমতে কমতে ঋণাত্মক জায়গায় গিয়ে পৌঁচেছে, দু’টি সম্পর্কযুক্ত। সুদের হার কম মানে বিনিয়োগের জন্য অঢেল টাকা খুব কম সুদে পাওয়া যায়

এখন সুইডেনে বা নগদহীন অর্থনীতির যে কোনো নাগরিকের সামনে কি কি পথ খোলা রইল। তার অর্জিত অর্থ নগদে সে ঘরে রাখতে পারবে না, কারণ সেই নগদ টাকায় সে কোনো কিছু কিনতে পারবে না, কারণ নগদে কেউ কিছু বিক্রি করবে না। একটাই পথ গোটা টাকাটা তাকে ব্যাঙ্কে রাখতে হবে। কিন্তু ব্যাঙ্কে রাখলে ঋণাত্মক সুদের কারণে তোমার টাকার একটা অংশ ব্যাঙ্ক কেটে নেবে, তোমার সঞ্চয়ের পরিমাণের ক্রমাগত ক্ষয় হবে। অন্য পথ হলো সঞ্চয়ের টাকা নগদহীন ভাবে খরচ কর। যদি ব্যাঙ্কে টাকা রেখে দাও তবে সে টাকা নামমাত্র সুদে বিনিয়োগকারীর হাতে পৌঁছবে। আর যদি জিনিস কিনে সেই টাকা খরচ করো তাহলেও তোমার টাকার একটি অংশ মুনাফা হিসাবে মালিকের হাতে পৌঁছবে। অর্থাৎ তুমি যাই করো লাভ মালিকদের, তোমার নয় — অথচ টাকার মালিক তুমি।

আধুনিক পৃথিবীতে যে কোনো মানুষের সবচেয়ে মৌলিক যে অর্থনৈতিক অধিকার আছে তা হলো নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে আয় করার অধিকার। এই আয়ের একটি ছোটো অংশ রাষ্ট্রকে কর হিসাবে দিয়ে বাকি টাকাটার মালিক তুমি। তুমি ঠিক করবে সেই টাকা দিয়ে তুমি কি করবে।

সেই টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে তুমি ক্রেতা ঠিক করবে। কি কিনবে তা ঠিক করবে। তোমাকে এই অধিকার দেয় রাষ্ট্র। এক টুকরো কাগজে রাষ্ট্রের হয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক লিখে দেয় এই কাগজ যার হাতে সে এই টাকার মালিক। সেই পরিমাণটিও কাগজে ছাপা থাকে। এই হলো নগদ টাকা। এই গোটা প্রক্রিয়ায় সে স্বাধীন এবং নোটের বিনিময়ে পণ্য বিক্রি করবে যে বিক্রেতা সেও স্বাধীন। দুই স্বাধীন নাগরিকের মধ্যে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি থাকবে না। নগদহীন অর্থনীতিতে এই মৌলিক অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অবসান। এক, তুমি তোমার টাকা নিয়ে কি করবে সেটা পুরোপুরি তুমি ঠিক করবে না। সেটা ঠিক করবে সরকার অথবা সরকারের হয়ে ব্যাঙ্ক, সে ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্ত হতে পারে, বেসরকারিও হতে পারে, দেশি ব্যাঙ্ক পারে, বিদেশি ব্যাঙ্কও হতে পারে।

ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যেকার স্বাধীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেরও কোনো অস্তিত্ব নগদহীন ব্যবস্থায় থাকবে না। তুমি বিক্রেতাকে সরাসরি জিনিসের দাম দিতে পারবে না। তোমার হয়ে তৃতীয় পক্ষ দাম দেবে। সে তৃতীয় পক্ষ হতে পারে ব্যাঙ্ক হতে পারে যে কোম্পানির কার্ড তুমি ব্যবহার করছ সেই কোম্পানি। তুমি বিক্রেতাও সব সময় স্বাধীনভাবে ঠিক করতে পারবে না। বিজ্ঞাপন দিয়ে ডিসকাউন্ট দিয়ে কার্ডের কোম্পানি তোমাকে প্রভাবিত করবে বিশেষ কোম্পানির জিনিস কিনতে। এমনকি চরম ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ বিক্রেতাকে টাকা দিতে অস্বীকার করতে পারে সে। তুমি কোনো একটি সংগঠন, বা রাজনৈতিক দলকে টাকা দিতে চাও। কার্ডের কোম্পানি সরকারি বির্দেশ উল্লেখ করে সেই টাকা দিতে অস্বীকার করতে পারে। পৃথিবী জোড়া কার্ডের ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করে দু’টি মার্কিন কোম্পানি — ভিসা এবং মাস্টারকার্ড। এদের ক্ষমতা বোঝাবার জন্য ভিসার উদাহরণ দেওয়া যায়। ২০১৫ সালে গোটা পৃথিবীর ১লক্ষ কোটি লেনদেন হয়েছে ভিসার মাধ্যমে। এতে লেনদেন হয়েছে ৬.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর ২৫০০০ ব্যাঙ্কের হয়ে ভিসা কাজ করে। এরা সিদ্ধান্ত ক’রে উইকিলিক্সের ‍‌(যারা সমস্ত গোপন ইলেকট্রনিক বার্তা ফাঁস করে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে বেআব্রু করে দিয়েছে।) টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একইভাবে কয়েকটি বিশেষ রাশিয়ান ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে এরা। এবং এই তথাকথিত ‘তৃতীয় পক্ষ’ মাগনায় কোনো কাজ করে না। নগদ ভিত্তিক অর্থনীতিতে ক্রেতা নগদে দাম দেয়, বিক্রেতা তার মাল দেয়। এর মধ্যে আর কোনো টাকা পয়সার লেনদেন থাকে না। কিন্তু নগদহীন ব্যবস্থায় এই তথাকথিত ‘তৃতীয় পক্ষ’ প্রতিটি লেনদেন থেকে টাকা পায়, ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকে। এবং এই টাকা তারা দিতে বাধ্য।

আজ গোটা দুনিয়া জুড়ে নগদহীন অর্থনীতির দাবিতে সমস্বরে কোলাহল করা হচ্ছে। তাতে গলা মিলিয়েছে রাজনৈতিক নেতা, বড় বড় কোম্পানি, নিজের ভালো-মন্দ না বোঝা কিছু মূর্খ মানুষ। কিন্তু সবচেয়ে সজোরে চেঁচাচ্ছে এই ‘তৃতীয় পক্ষ’ কোম্পানিগুলো। নগদ ১০টাকা দিয়ে কেউ যদি এক কিলো আলুও কেনে তাহলে এই তৃতীয় পক্ষরা মনে করে তাদের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল।

পৃথিবীতে ২০০৮ থেকে লাগাতার সংকট চলছে — নতুন বিনিয়োগ নেই, বাজারে স্থায়ী মন্দা, কর্মসংস্থান তলানিতে। তথাকথিত নগদহীন অর্থনীতি এবং সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে চেষ্টা চলছে মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদকে ব্যবহার করে বাজার চাঙ্গা করতে, নতুন বিনিয়োগ ব্যবস্থা করতে। এবং এই প্রক্রিয়াটাই এক কথায় একটি নিকৃষ্ট রাহাজানিতে পরিণত হয়েছে।

এই রাহাজানির তালিকায় আমাদের দেশ থাকবে না, এ হয় না। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রাথমিক কারণও একটি বিশুদ্ধ রাহাজানি। বেসরকারিকরণের ঢাক গত ২৫বছর ধরে বাজানো হচ্ছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে এখনও নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো। দেশের মোট আমানতের ৭২%-ই আছে ১৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কাছে। মোদীর ‘আচ্ছে দিনের’ ছোঁয়া এই ব্যাঙ্কের গায়েও লেগেছে। ২০১৪-১৫ সালে এই ব্যাঙ্কগুলোর সম্মিলিত লাভের পরিমাণ ছিল ৩৬হাজার কোটি টাকা। আর এ বছরে লাভ উলটে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৮হাজার কোটি টাকা। এটা যে কোনো ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে একটি অশনি সংকেত। বিপদটা সরকারও বুঝেছিল।

কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এই দুরবস্থার একটিই কারণ — তারা যে টাকা ধার দিয়েছিল তার একটা বড় অংশ তারা ফেরত পায়নি। এই পরিমাণটা আঁতকে ওঠার মতো, প্রায় ১১লক্ষ কোটি টাকা। এবং এটা প্রধানত হয়েছে দেশের অর্থনীতির মাতব্বররা তাদের ধারের টাকা ফেরত দেয়নি বলে। এই বকেয়ার তালিকায় শীর্ষস্থানে আছে অনিল আম্বানি। প্রধানমন্ত্রীর অনুজতুল্য গৌতম আদানীর বকেয়ার পরিমাণও বিপুল। মার্কিনী পরামর্শদাতারা ম্যাকিনসে সরকারকে সাবধান করে যদি অবিলম্বে সরকার যথেষ্ট পরিমাণ মূলধন এই ব্যাঙ্কগুলোতে বিনিয়োগ না করে তবে দেশে গোটা ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাটা ভেঙ্গে পড়বে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কাছেই জমা আছে দেশের ৭২% টাকা। সরকার নীতিগতভাবে এই প্রস্তাব মেনে নেয়। কিন্তু ‘আচ্ছে দিন’-র ঠেলায় সরকারেরও ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’। এই টাকা সরকার দিতে পারেনি। নোট বাতিল করে মানুষের ওপর এই বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। আমার আপনার মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো টাকা, মায়ের চিকিৎসার জন্য সামান্য সংস্থান — এই সব নিয়ে আমরা ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হলাম, কারণ আম্বানি, আদানী বিজয় মালিয়ারা ফুর্তি করে টাকা উড়িয়েছে, ব্যাঙ্কের ধার শোধ করেনি। এদের কিছু হবে না কিন্তু আমার আপনার পকেট থেকে ১৪.৫০ লক্ষ কোটি টাকা সরকার তুলে নিয়ে চলে গেল এ ক’দিনে ব্যাঙ্ক বাঁচাতে। অথচ আমরা কোনো অপরাধ করিনি।

এটা গেল প্রাথমিক কারণ — কিন্তু চূড়ান্ত লক্ষ্য ‘নগদহীন অর্থনীতি’। দেশের বর্তমান অবস্থায় এটা অসম্ভব এটা কেবল আমি, আপনি জানি তাই নয়, নরেন্দ্র মোদীও জানেন। যে দেশের ৩৫কোটি মানুষের দৈনিক আয় ৪০টাকারও কম, যে দেশের সিংহভাগ গরিব মনুষ দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল সে দেশে নগদহীন অর্থনীতি আসতে শতাব্দী পার হয়ে যাবে। তাহলে? যেটুকু আছে তাই বা কম কিসের? National Council of Applied Economics Research (NCAER)-এর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ২৬.৭ কোটি আর দশ বছর পরে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৪.৭ কোটি। মধ্যবিত্ত মানে যার যথেষ্ট ক্রয়ক্ষমতা আছে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সঞ্চয় আছে — এটি একটি বিশাল বাজার। সংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার সমান। দেশের সবচেয়ে গরিব যে অংশ, প্রায় কাছাকাছি। দেশের অর্থনীতি যাদের ভূমিকা ন্যূনতম — তাদের গোল্লায় পাঠিয়েও যা পড়ে থাকে তাকে যদি নগদহীন ব্যবস্থার ছাঁচের সঙ্গে এনে ফেলা যায় তাহলেই হলো — দেশ লুণ্ঠনের সোনার খনি হয়ে যাবে। যত সঞ্চয় কমবে সেই অনুপাতে বাজার বাড়বে, বিনিয়োগ বাড়বে, মুনাফা বাড়বে। আমাদের দেশে বর্তমানে বিনিয়োগ প্রায় নেই। কর্মসংস্থান বন্ধ। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য এদের কিছু যায় আসে না, কিন্তু কর্পোরেটের মুনাফাতেও তো টান পড়বে। গরিব ছিলই, এখন এই মধ্যবিত্তের মাথায় নগদহীন কাঁঠালটি ভাঙলে বড়লোকদের ‘আচ্ছে দিন’ আসবেই আসবে।

এবং এতে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাটাও ধীরে ধীরে প্রাইভেট এবং বিদেশি ব্যাঙ্কের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। ব্যাঙ্কের সাধারণ আমানত প্রধানত আসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে। কিন্তু নগদহীন ব্যবস্থার গোটাটা ছুটবে ইলেকট্রনিক বিনিময়ের দিকে। যেমন আমাদের দেশে বর্তমানে কার্ডের মাধ্যমে যে লেনদেন হয় তার ৫৪% হয় প্রাইভেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে, ২২% হয় বিদেশি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। আর বাকি ২৬% লেনদেনও পুরোপুরি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মাধ্যমে হয় না, অল্প হলেও কিছু সমবায় ব্যাঙ্কও দেশে কার্ড ব্যবসায় ঢুকেছে, তাদেরও একটা ভাগ থাকবে। Cash Less ব্যবস্থা আসলে ধাপে ধাপে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক — less ব্যবস্থায় পরিণত হবে। আম্বানি, আদানী, বিজয় মালিয়াদের একটু অসুবিধা হবে। কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের টাকা তারা যেভাবে লুট করতে পারে প্রাইভেট ব্যাঙ্কের থেকে সেটা করা যাবে না। এতে দুঃখ করে কোনো লাভ নেই। পাকা আমের যতটা রস ছিল সব তারা খেয়েছে — এখন আঁটি নামক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ছুঁড়ে ফেলতে হবে। আর এস এস-প্রণীত দেশপ্রেমের গানে জয় ভারত, জয় মোদীর সাথে জয় ভিসা, জয় মাস্টারকার্ড এটাও যুক্ত হবে। আমরা সত্যি সত্যিই আধুনিক হব।


   সৌজন্যেঃ গণশক্তি

Cashless Economy of Chikalthana

November 25, 2016

চিকলথানার ক্যাশলেস ইকনমি

পি সাইনাথ

1111

নোট বাতিলে মহারাষ্ট্র জুড়ে বিপর্যস্ত কৃষক, ভূমিহীন খেতমজুর, পেনশনভোগী, ছোট ব্যবসাদার ও আরো আরো অনেকে। মোদীর ‘মাস্টার স্ট্রোকে’ তাঁদের সেই জীবনযন্ত্রণাই তুলে ধরলেন স্বনামধন্য সাংবাদিক পি সাইনাথ

এখানে এলে মনে হতেই পারে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ক্যাশলেস ইকনমির খোয়াব বাস্তবায়িত হয়েছে। মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ শহরের একেবারে গা ঘেঁষে থাকা এই চিকলথানা গ্রামে সেই স্বপ্ন ঘোর বাস্তব। এখানে কারও হাতে কোনো নগদ টাকা নেই। ব্যাঙ্ক ও, এটিএম-এও নেই। তাই সেগুলির আশপাশে একবুক হতাশা নিয়ে মানুষের আনাগোনা, লাইন কোনোটাই নেই। এমনকি ব্যাঙ্কের শাখার বাইরে ভ্যানে বসা কোনো পুলিশকর্মীকে ওই চৌহদ্দিতেই নজরে পড়বে না।তবে চিন্তার কিছু নেই। খুবই শীঘ্রই ওই গ্রামের মানুষও তাঁদের আঙ্গুলে কালির দাগ দেখতে পাবেন।

চলুন ঘুরে আসা যাক দুর্গ শহর ঔরঙ্গাবাদের ভেতর থেকে। স্টেট ব্যাঙ্ক অব হায়দরাবাদের শাহগঞ্জ শাখায় ঢুকলেই নজরে পড়বে মরিয়া ব্যাঙ্ককর্মীরা তাঁদের গরিব ক্লায়েন্টদের সাহায্য করার জন্য ‘সংগ্রামরত’। সেখানে কেন, শহরের অন্য শাখা, প্রত্যেকটি শাখায় এখন ছেঁড়া-ফাটা ৫০, ১০০টাকার নোট ঝাড়াই-বাছাই চলছে। চূড়ান্তভাবে নষ্ট করে ফেলার জন্য এগুলির সবকটিই রিজার্ভ ব্যাঙ্কে পাঠানোর কথা। উপায় না দেখে এখন সেই বাতিল নোটই আবার নতুন করে বিলি করার ব্যবস্থা হচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কও বিষয়টা ভালোই জানে, কিন্তু নীরবতা দিয়েই ব্যাপারটা উপেক্ষা করে চলেছে।

‘‘আমাদের আর কীই বা উপায় আছে?’’ জানতে চাইছেন এই সমস্ত ব্যাঙ্কের কর্মীরা। ‘‘লোকের তো এখন ছোট নোট দরকার। ওদের সমস্ত কাজকর্ম, লেনদেন বন্ধ হয়ে রয়েছে।’’ ব্যাঙ্ককর্মীদের সঙ্গে কথার মাঝেই সেখানে এসে হাজির জাভেদ হায়াত খান। ঠেলাওয়ালা, বাড়ি বাড়ি জিনিস ফেরি করে পেট চলে। রবিবার ব্যাঙ্কের বাইরে প্রায় এক কিলোমিটার লাইন পেরিয়ে যখন ব্যাঙ্কের দোড়গোড়ায় পৌঁছালেন, তাঁর হাতে ধরা মেয়ে রশিদা খাতুনের বিয়ের কার্ড।

‘‘সবমিলিয়ে আমার অ্যাকাউন্টে ২৭হাজার টাকা রয়েছে।’’ বলছিলেন, ‘‘তিন সপ্তাহ পরে মেয়ের বিয়ে, আর আমাকে বলা হচ্ছে মেয়ের বিয়ের জন্য মাত্র দশ হাজার টাকা তোলা যাবে। আমিই আমার টাকা তুলতে পারবো না।’’ আগের দিন দশহাজার টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ায় ব্যাঙ্ক তাঁকে ফেরত পাঠাচ্ছে। যদিও আজও তাঁর ওই একই টাকা তোলার এক্তিয়ার রয়েছে। কারণ ব্যাঙ্ককর্মীদের আন্দাজ, যেভাবে ব্যাঙ্কের চারপাশে সর্পিল লাইন বেড়ে চলেছে তার জন্য তাদের হাতে থাকা টাকা যথেষ্ট নয়। আর তাঁরা চাইছেন এই লাইনগুলির প্রত্যেকে যেন কিছু না কিছু টাকা পান। এঁদেরই দুজন এখন জাভেদকে সাহায্য করতে চান। তাঁরাই জানালেন, মেয়ের বিয়ের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে ওই টাকা তাঁর অ্যাকাউন্টে এসেছে।

বহু নিবন্ধকার, বিশ্লেষক আর সরকারি রিপোর্ট এরই মধ্যে তুলে ধরেছে, ভারতের ‘কালো’ অর্থনীতির বড় অংশটাই রয়েছে সোনা-রুপোর বাজার, বেনামী জমির কারবার ও বৈদেশিক মূদ্রার কবলে। পুরানো কাঠের সিন্দুকে ঠাকুমার জমিয়ে রাখা নোটের গাদায় নয়। ভারত ও বিদেশের কালো টাকা মোকাবিলায় পদক্ষেপ সম্পর্কে ২০১২সালের একটি রিপোর্টে এই কথাটাই বলেছিলেন সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্সের চেয়ারম্যান। ১৯৪৬ ও ১৯৭৮-এ অতীতের দু-দুবার টাকা বাতিলের ‘শোচনীয়ভাবে ব্যর্থতার’ কথাও ওই রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছিল (পৃষ্ঠা ১৪, পার্ট টু, ৯.১)। তা সত্ত্বেও সেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি করলো বিজেপি সরকার। এমন একটা অবিশ্বাস্য নির্বুদ্ধিতার কাজকে বাহবা দিতে হরেক কিসিমের অ্যাঙ্কর আর টেলিভিশন ভাঁড়রা ‘মোদীর মাস্টারস্ট্রোক’ বলে গলা ফাটাচ্ছে, তা আসলে গ্রাম ভারত জুড়ে মর্ম বেদনা আর দুর্গতিই ছড়াচ্ছে। এতে যদি কারও ‘স্ট্রোক’ হয়ে থাকে তা হলো ওই গ্রামীণ অর্থনীতির হৃদয়েই।

আর সেই স্ট্রোকের ধাক্কা থেকে সেরে উঠতে কতটা সময় লাগতে পারে তা প্রথমেই গুলিয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও তাঁর দলীয় সহকর্মীরা, ২-৩দিনের অস্বস্তি বলে। ড. জেটলি আবার পরে তা শুধরে নিয়ে বললেন ২-৩সপ্তাহ। ঠিক তারপরই তাঁর সিনিয়র সার্জেন, নরেন্দ্র মোদী, বললেন যে রোগীর স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধারে তাঁর ৫০দিন সময় চাই। তাহলে ২০১৭-তেও চলবে আমাদের এই চিকিৎসা পর্ব। আমরা জানি না এর মধ্যে দেশজুড়ে আরো কত মানুষ লাইন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে মরে যাবেন, তবে প্রতিদিন তাঁদের সংখ্যা বাড়বে।

‘‘নাসিকের লাসালগাঁওতে, কিষানরা নগদ সংকটে পেঁয়াজ বাজারই বন্ধ করে দিয়েছে’’, খবর দিলেন আধুনিক কিষান সাপ্তাহিকীর সম্পাদক নিশিকান্ত ভালেরাও। ‘‘বিদর্ভ আর মারাঠাওয়াড়ায় তুলোর দাম প্রতি কুইন্টালে ৪০শতাংশ পড়ে গেছে।’’ সামান্য কিছু লেনদেন ছাড়া বিক্রিবাটা বন্ধ হয়ে রয়েছে। ‘‘কারও হাতে কোনো ক্যাশ নেই। কমিশন এজেন্ট, পণ্য উৎপাদন, ক্রেতা সকলেই সমানভাবে সমস্যার মধ্যে রয়েছেন,’’ জানালেন দ্য টেলিগ্রাফের নাগপুরের সাংবাদিক জয়দীপ হারদিকার। ‘‘গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলিতে চেক জমা দেওয়া সবসময়েই একটা ক্লান্তিকর ব্যাপার ছিল আর এখন টাকা তোলা হলো একটা দুঃস্বপ্ন।’’

তাই, খুব কম কৃষকই চেক নেবে। কিন্তু কবে যে এগুলি দিয়ে টাকা তোলা যাবে তার অপেক্ষায় থাকলে ওদের সংসার চলবে কী করে? অনেকেরই আবার চালু কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই।

এই রাজ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সারা দেশে ৯৭৫টা এ টি এম রয়েছে। তার মধ্যে ৫৪৯টা হতাশা ছাড়া আর কিছুই পরিবেশন করছে না। ওই অচল এ টি এম-গুলির বেশিরভাগই গ্রামীণ এলাকায়। এর প্রভাবের একটা ছেঁদো যুক্তি খাড়া করা হয়, ‘‘গ্রামীণ এলাকা ধারের উপরেই চলে। নগদের এখানে কোনো মানেই নেই।’’ সত্যিই? এটাই এখানে সবকিছু।

একেবারে নিচের স্তরে লেনদেনের সিংহভাগটাই চলে নগদে। এক সপ্তাহের মধ্যে ছোট নোট না পৌঁছালে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যার ভয় পাচ্ছেন ছোট গ্রামীণ শাখার ব্যাঙ্ককর্মীরা। অন্যরা বলছেন, সংকট তো এর মধ্যেই রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কিছু নগদ এলেও তা কিছুই কমবে না।

ঔরঙ্গাবাদে আরেকটা লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে পারভেজ পাঠান। এক কনস্ট্রাকশন সাইটের সুপারভাইজার। ভয় পাচ্ছেন কখন তাঁর সাইটের শ্রমিকরা খেপে গিয়ে তাঁকে মারতে আসেন। ‘‘ওরা তো ওদের কাজ করেছে, ওদের তো পয়সা দিতে হবে।’’ বলছিলেন, ‘‘কিন্তু আমার হাতে কোনো নগদ টাকা নেই।’’ চিকলথানা গ্রামে, রাইস আখতার খান বলছিলেন, তিনি আর তাঁর মতোই কমবয়সি অন্য মায়েদের এখন ছেলেমেয়ের জন্য খাবার জোগাড়ই দায় হয়েছে। কখনই বা তাঁরা করবেন এসব। ‘‘কারণ দিনের বেশিরভাগটাই তো চলে যাচ্ছে লাইন দিতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে, ছেলেমেয়েগুলো অভুক্ত থেকে যাচ্ছে।’’

লাইনে দাঁড়ানো বেশিরভাগ মহিলাই বলছেন, তাঁদের হাতে ২-৪দিনের সুযোগ আছে। খুব কষ্ট করেও তাঁরা এমনটা ভাবতে পারছেন না, তার মধ্যে ক্যাশ ফ্লো’র সমস্যা মিটে যাবে। হায়! সমস্যা মেটার নয়।

কৃষক, ভূমিহীন খেতমজুর, গৃহপরিচারক, পেনশনভোগী, ছোটখাটো ব্যবসাদার, আরও অনেকে- সকলেই ভয়ানক আঘাতের মুখে। এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁরা শ্রমিকদের কাজে লাগাতে গিয়ে ধারের খাতায় চলে যাবেন, মজুরি মেটাতে টাকা ধার করতে হচ্ছে। আবার অন্যদের মতো তাঁদের খাবার কিনতে পয়সা জোগাড় করতে হচ্ছে। ঔরঙ্গাবাদ স্টেশন রোডে স্টেট ব্যাঙ্ক অব হায়দরাবাদের শাখার এক কর্মী জানালেন, ‘‘যত দিন যাচ্ছে, আমাদের লাইন বেড়েই চলেছে, কমার নাম নেই।’’ হাতে গোনা এই সামান্য কর্মী নিয়ে এই বিপুল পরিমাণ লোক সামাল দেওয়া মুখের কথা। আরেক কর্মী আবার তুলে ধরলেন সফটওয়ারের ত্রুটির কথা, যা পরিচিতিপত্র ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে।

লোককে দুটো ২০০০টাকা নোটের জন্য সর্বোচ্চ আটটা ৫০০ কিংবা চারটি ১০০০টাকা নোট বদলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটা এককালীন লেনদেন। ‘‘হ্যাঁ, পরদিনই যদি আপনি আবার চেষ্টা করেন তাহলে আপনার ধরা পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আপনি এই ফাঁদ এড়িয়ে যেতে পারেন। কিছুই না, কেবল একটা অন্য আইডি ব্যবহার করুন। আজ যদি আপনি আধার কার্ড ব্যবহার করেন, কাল তাহলে আপনার পাসপোর্ট নিয়ে আসুন, তার পরদিন আনুন প্যান কার্ড, ধরা না পড়েই আপনি বারে বারে টাকা বদলে যেতে পারবেন।’’

এখন, বাস্তবে যদিও কম লোকই এমনটা করছেন। বেশিরভাগই সিস্টেমের এই ত্রুটির কথাটা জানেই না। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া উন্মাদের মতো। ওরা এখন লোকের হাতে ভোটের কালি লাগানোর কথা ঠিক করেছে। কালি লাগানো হবে ডানহাতে যাতে যেখানে যেখানে উপনির্বাচন রয়েছে সেখানে কোনো সমস্যা না হয়।

স্টেশন রোডের লাইনে দাঁড়ানো ছোট ঠিকাদার আর পাতিল বললেন, ‘‘সরকারের অর্ডার নিয়ে কখনো ভাববেন না।’’ ‘‘বাস্তবে কোথাও কোনো হসপিটাল বা ওষুধের দোকানে ৫০০ বা ১০০০-এর নোট নিচ্ছেই না।’’ পাতিলের পাশে দাঁড়ানো সঈদ মোদক বলে উঠলেন। পেশায় কাঠের মিস্ত্রি সঈদকে গুরুতর অসুস্থ এক নিকটাত্মীয়কে নিয়ে ক্লিনিকে ক্লিনিকে ঘুরতে হয়েছে। ‘‘প্রত্যেক জায়গা থেকে আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’ বলছিলেন, ‘‘হয় তারা ২০০০টাকার নোট নেবে না, নয়তো বলেছে, খুচরো নেই।’’

এরই মধ্যে গোটা ভারতের চোখ এখন নাসিকের উপর, সেখান থেকে নতুন ছাপা নোট বেরিয়ে আসবে। গ্রামাঞ্চলের কেউই এখনও তা হাতে পাননি। তবে সকলেরই আশা  তা ঘটবে।


   Courtesy: Ganashakti

‘Chilcot Report’ Vindicates US-British Lies In Iraq War

July 8, 2016

415155

Honour 1953 Agreement On J&K

May 17, 2016

কাশ্মীরঃ ১৯৫৩ সালের চুক্তি পুনর্বহাল করতে হবে

220px-Kuldip_Nayar-2

কুলদীপ নায়ার

কাশ্মীর এখন স্বাভাবিক। কথাটা এই অর্থে বলা যায় কারণ, সেখানে আমরা পাথর নিক্ষেপের ঘটনা দেখিনি। জঙ্গিবাদও শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু তারপরও এই উপত্যকার মানুষের মনে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে। সেখানে পা দেওয়ামাত্র আপনি এটা বুঝতে পারবেন। এর জন্য অনেক কারণই দায়ী। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কাশ্মীরিদের মনে সাধারণভাবে এই বোধ সৃষ্টি হয়েছে যে ভারত কাশ্মীরের সবকিছুর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। যদিও কাশ্মীর তাকে স্রেফ তিনটি জিনিসের নিয়ন্ত্রণ দিয়েছিল: প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ।
এই অভিযোগের যৌক্তিকতা আছে। কারণ, রাষ্ট্রের একটি অংশ কেন্দ্রের কাছে কতটা সার্বভৌমত্ব সমর্পণ করবে, সেটা তার ওপরই নির্ভর করে। ফেডারেশন নিজে থেকে কিছু নিতে পারে না। কিন্তু নয়াদিল্লি ঠিক এ কাজটিই করেছে। জওহরলাল নেহরু ও শেখ আবদুল্লাহ ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, এ কারণেই তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়েছিল। শেখ ১২ বছর অন্তরীণ ছিলেন। তবে নেহরু নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, আর তা শোধরানোর জন্য তিনি শেখকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এনে রেখেছিলেন।
নয়াদিল্লি ও শ্রীনগরের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে ঠিক একই কারণে। কথা হচ্ছে, একজন মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে একই সঙ্গে কেন্দ্রের সুনজরে থাকবেন, আবার উপত্যকাবাসীর মনে এই অনুভূতি সৃষ্টি করবেন যে তাঁদের স্বতন্ত্র পরিচয় রয়েছে। এই চিন্তায় বিভিন্ন রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলোর ঘুম হারাম হয়ে যায়।
যাঁরা কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করেন, তাঁরা ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা মুছে দিতে চান। এঁরা একদিকে যেমন ভারতীয় সংবিধানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন, তেমনি অন্যদিকে কাশ্মীরিদের সঙ্গেও। দুঃখজনকভাবে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির চিন্তা একটু ভিন্ন, যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন পর্যন্ত এমন কিছু করেননি, যা কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন খাটো করতে পারে। কিন্তু এই উপত্যকার সর্বত্রই ভয় জেঁকে বসেছে
সে কারণেই কাশ্মীরের ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার বিষয়টি গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়েছে। যাঁরা একসময় কাশ্মীরের স্বাধীনতার ডাকে সামান্যই সাড়া পেতেন, তাঁরা কিন্তু এখন ভালোই সাড়া পাচ্ছেন। আর তাঁদের অনুসারীদের সংখ্যা যে দিনের পর দিন বাড়ছে, তাতে বিস্ময়েরও কিছু নেই।
নয়াদিল্লিকে এটা বুঝতে হবে, কাশ্মীরিরা যে ভারতের কাছ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চাইছে, তার মানে হয়তো এই নয় যে তারা নয়াদিল্লির কাছ থেকে শ্রীনগরের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ভাবছে। তারপরও কাশ্মীরিরা নিজেদের শাসন করছে—এমন একটি আবহ বজায় রাখতে হবে। মহারাজা হরি সিংয়ের পর শেখ আবদুল্লাহ রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শাসন চালু করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পার্টি নয়াদিল্লির খুব ঘনিষ্ঠ প্রমাণিত হওয়ায় রাজ্যসভায় হেরে গিয়েছিল।
পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি জিতেছিল, কারণ এর প্রতিষ্ঠাতা মুফতি মোহাম্মদ সাঈদ নয়াদিল্লি থেকে দূরে ছিলেন, যদিও বিচ্ছিন্ন হননি। কাশ্মীরিরা তাঁকে ভোট দিয়েছিল, কারণ তিনি তাদের মনে নয়াদিল্লির বিরুদ্ধাচরণের অনুভূতি সৃষ্টি করেছিলেন। ওমর ফারুক আবদুল্লাহকেও শেখের পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল একই কারণে। ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্ক খুবই নিবিড়, ফলে তারা তাকে একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের বাইরে গিয়ে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে না। কিন্তু বিরোধীরা তারপরও কাশ্মীরবাসীর মনে দিল্লি বিরোধিতার অনুভূতি বয়ে আনছে।
লর্ড সিরিল র‍্যাডক্লিফ কাশ্মীরকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তিনি ছিলেন লন্ডনের একজন বিচারক, যিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমারেখা টেনে দুটি পৃথক দেশের সৃষ্টি করেছিলেন। বহু বছর পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে বলেছিলেন, কাশ্মীর যে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সেটা তিনি বুঝতেই পারেননি।
কয়েক সপ্তাহ আগে শ্রীনগরে এক উর্দু ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার সময় আমি এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছিলাম। উর্দুকে অনেক রাজ্য থেকেই শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে, এমনকি পাঞ্জাব থেকেও, যেখানে এটি কিছুদিন আগেও প্রধান ভাষা ছিল। বস্তুত, পাকিস্তান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পরই ভাষাটি ভারতে গুরুত্ব হারিয়েছে।
নয়াদিল্লি যে এই ভাষাটির সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে, এ ব্যাপারে কাশ্মীরবাসীর মনে গভীর দুঃখবোধ রয়েছে। সাধারণভাবে ধারণা করা যায়, ভাষাটি অযত্ন ও অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে, কারণ এটিকে মুসলমানদের ভাষা বলে মনে করা হয়। নয়াদিল্লি যদি উর্দু ভাষাকে নিজের মনে করত এবং এর চর্চাকে উৎসাহিত করত, তাহলে কাশ্মীরবাসীর সংক্ষুব্ধ হওয়ার একটি কারণ অন্তত কমে যেত।
ভারতের বাকি জনগণের মতো কাশ্মীরবাসীও গরিব, তাদের চাকরির দরকার। তারা মনে করে, শুধু উন্নয়নের মধ্য দিয়েও এটা সম্ভব, তার সঙ্গে আছে পর্যটন। কিন্তু তারা জঙ্গিদের তাড়ানোর জন্য বন্দুক বা অন্য কোনো অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে না। প্রথমত, তারা জঙ্গিদের ভয় করে। দ্বিতীয়ত, তারা মনে করে, এই জঙ্গিরা তাদের একটি পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে তারা যে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে না, তার কারণ হচ্ছে, এটা তাদের স্বাভাবিক বিচ্ছিন্নতাবোধেরই অংশ।
কয়েক বছর আগে কাশ্মীরে যে প্রলয়ংকরী বন্যা হয়েছিল, তারপর নয়াদিল্লি উপত্যকাটির জন্য প্যাকেজ দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল, তারা সেটা দেয়নি। ব্যাপারটা দুঃখজনক। গণমাধ্যমও এই কথা ভঙ্গের সমালোচনা করেনি। নেতারাও কিছু বলেননি। ফলে কাশ্মীরবাসী মনে করে, এটা নয়াদিল্লির দায়সারা কথা ছিল
আমি এখনো বিশ্বাস করি, ১৯৫৩ সালের চুক্তিতে যে ভারতকে কাশ্মীরের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটা এখনো এই উপত্যকার পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে পারে। কাশ্মীরের তরুণেরা রাজ্যের মর্যাদা নিয়ে ক্ষুব্ধ, ফলে তাঁদের জয় করার জন্য এই নিশ্চয়তা দেওয়া যেতে পারে যে পুরো ভারতের বাজার তাদের জন্য উন্মুক্ত।
কিন্তু শুধু এতেই যে কাজ হবে, এমনটা মনে হয় না। নয়াদিল্লিকে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ছাড়া আর অন্য সব ক্ষেত্রে জারি করা বিধান বাতিল করতে হবে। ২৫ বছর আগে যে বিশেষ ক্ষমতা আইন জারি করা হয়েছিল, সেটা এখনো বলবৎ আছে। সরকার যদি এটা প্রত্যাহার করে, তাহলে যেমন কাশ্মীরিরা শান্ত হবে, তেমনি অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনী আরও দায়িত্বশীল হবে।
মানুষ তো মনের শান্তি চায়। কাশ্মীরিদের অবশ্যই মনে করতে হবে যে তাদের পরিচয় আক্রমণের মুখে পড়েনি, সেই সঙ্গে নয়াদিল্লিকেও কাশ্মীরিদের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে হবে। আর ১৯৫৩ সালের চুক্তি পুনর্বহাল করা হলে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটতে পারে, তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

Biriyani Checkmates Noodles & Rolls

May 15, 2016

চাউমিন, রোলকে টেক্কা বিরিয়ানির

তাপস গঙ্গোপাধ্যায়

 biriyani1

গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশ‌কের মাঝামাঝি, বর্ষার বিকেলে রবীন্দ্র সরোবরের মাঠে ফুটবলের নামে কাদাজল ঘেঁটে সন্ধ্যার মুখে বাড়ি ফেরার সময় যেদিন তারকদা আমাদের নেতাজি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ঢুকতে বলে ঢাকাই পরোটার অর্ডার দিতেন, সেদিন মনে হত এর চেয়ে বেশি সুখ একটা স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছেলে আর কি চাইতে পারে বা পেতে পারে।কলেজ পেরিয়ে যখন ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি রেগুলার সেই ষাটের দশকের গোড়ায় সুযোগ পেলেই, এবং পকেটে রেস্ত থাকলে চলে যেতাম ‌এসপ্ল্যানেডে একটি দেবভোগ্য খাদ্য আস্বাদের আকাঙ্খায়। দু’‌আনায় এক বাটি ছোলার ডালের সঙ্গে মুচমুচে করে ভাজা অনেকটা দশ–‌বারো পরতের ফুলকো লুচির মতো দেখতে ঢাকাই পরোটা নয়, দেবভোগ্য খাদ্যটির ঠিকানা ছিল সুরেন ব্যানার্জি রোডের অনাদি কেবিন। ছ’‌আনায় প্লেট ওপচানো মোগলাই পরোটায় জিভের আরাম, মনের বিরাম দুই–‌ই মিলত। কিন্তু ডিমের কুসুমে চোবানো পরোটাকে কেন মোগলাই বলা হত তা আজও পরিষ্কার নয়।

সত্তর দশকে অনাদি কেবিনের জায়গা দখল করল নিজাম। মোগলাই পরোটার জায়গায় দুটি পুরুষ্টু ডালডায় সাঁতরে ওঠা পরোটার সঙ্গে এক প্লেট কাবাব, সঙ্গে আর এক প্লেট পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা ও লেবু। হুরি পরিদের সঙ্গে বেহস্তেই শুধু ওই অনবদ্য ভোজ্য সুলভ তা জেনে গেছি ততদিনে। সুলভ বলছি বটে তবে পাঁচ সিকি মানে এক টাকা চার আনা সত্তর দশকের গোড়ায় নেহাত সস্তা নয়।

কিন্তু সত্তর দশকের শেষে পরোটা কাবাবের আলাদা অস্তিত্ব ঘুচে গেল যখন পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে মোড়ে, অলিতে গলিতে চাকা লাগানো কাঠের চলমান ভোজশালায় পরোটার ভেতরেই পাটিসাপটার ক্ষীরের বদলে কাবাবের তিন চার পিস টুকরো পেঁয়াজ লেবুর রস দিয়ে খবরের কাগজের আধফালি দিয়ে মুড়ে হাতে তুলে দিয়ে দোকানি এক গাল হেসে বলতেন, খেয়ে দেখুন— চিকেন রোল। একটাতেই পেট ভরে যাবে। তখন দাম ছিল দেড় টাকা। পরে বাড়তে বাড়তে সেই রোলই আজ বিকোচ্ছে তিরিশে, সঙ্গে এগ থাকলে চল্লিশে।

স্থায়ী দোকানে এগ–‌চিকেন খানদানের সুবাদে যখন পঞ্চাশ ছাড়াল, যখন কলকাতা ছাড়িয়ে মফস্‌সলের সব শহরে, গঞ্জে, সিনেমা হলের পাশে, বাজারে, স্কুল–‌কলেজের দরজায় দরজায় রোলের বাজার তুঙ্গে, ঠিক তখনই গত শতাব্দীর নব্বই দশকের মাঝামাঝি রাইটার্সের পেছনে লায়ন্স রেঞ্জে, ক্যামাক স্ট্রিটের ফুটপাথে লাল শালুতে মোড়া পেল্লায় সব পেতলের হাঁড়ি নিয়ে হাজির হলেন নতুন শতাব্দীর আগমনী বার্তা দিয়ে ইস্তানবুল, খোরাসান, সমরখন্দ, তেহরান, দামাস্কাসের ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাঁধুনিদের বাঙালি ভাই–‌বেরাদাররা। তেমুজিন, যাকে ইতিহাস চেনে চেঙ্গিস খাঁ নামে, তিনি ভালবাসতেন চাল ও একটুকরো ঘোড়ার মাংসের ওই অসামান্য শিল্প, যা আজ আমাদের কাছে পরিচিত বিরিয়ানি নামে।

আর গত বিশ বছরে বিরিয়ানি কালচার গোটা রাজ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে রোলের দোকান আগে বাড়ির বাইরে পা বাড়ালেই হাতের কাছে মিলত, তা এখন কলকাতায় খুঁজতে হয়। রোলের দোকান আছে, সেই সঙ্গে আছে বাঙালি চাউমিনের খানাও, কিন্তু ৮০, ৯০–‌এর দশকে দুটি বস্তু যেন কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছিল সেই সহজ লভ্যতা আর নেই। বাঙালি তুর্কি রোল চীনে নুডলসের ঘ্যাঁট ছেড়ে এখন ঝুঁকেছে চেঙ্গিস, তৈমুর লং–‌এর প্রিয়খাদ্য বিরিয়ানিতে।

বিশ বছর আগে এক বন্ধুর মুখে শুনলাম, রয়্যাল, আমিনিয়া, বিহার, নিজাম, জিশান, আর্সেলানের বিরিয়ানি তো ঢের খেয়েছ, কিন্তু ‘‌দাদা–‌বৌদি’‌র বিরিয়ানি কখনও চেখে দেখেছ?‌ মাদ্রাজি কায়দায় দু’‌দিকে ঘাড় নাড়িয়ে কবুল করলাম — না। তাহলে সোজা চলে যাও। ব্যারাকপুর রেল স্টেশনে। স্টেশন বাড়ির উল্টোদিকেই পাশাপাশি দুটি ঘর। আগে যখন দাদা ও বৌদির সম্পর্ক মধুর ছিল তখন ওই দুটি ঘর জুড়েই ছিল দাদা–‌বৌদির বিরিয়ানির একটাই দোকান। পরে ছাড়াছাড়ির পর একটা শুধু দাদার আর অন্যটা বৌদির হলেও নামে সেই সাবেকি আভিজাত্য— দাদা–‌বৌদির। বলব কি এক দুপুরে ওই বিরিয়ানিতে নাক গুঁজে প্লেট সাবড়ে যখন টালিগঞ্জের বাসায় ফিরে এলাম তখনও মনে হচ্ছে এই অমৃতের স্বাদ তো তাবৎ বাঙালির প্রাপ্য। অথচ প্রচার নেই।

আর গত বিশ বছরে সেই অলৌকিক ঘটনাই লৌকিক হয়ে গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে গেছে। পাঞ্জাব–‌হরিয়ানা–‌পশ্চিম ইউ পি–‌তে কৃষি বিপ্লব হয়েছিল ষাটের দশকের শেষাশেষি, পশ্চিমবঙ্গে বিরিয়ানি বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে গত বিশ বছরে। একটা এগ–‌চিকেন রোলের দামেই এক প্লেট বিরিয়ানি এখন সর্বত্র লভ্য। নব্বই দশকের শেষ, নতুন শতকের শুরুতে এক জোড়া মুরগির ডিম পাওয়া যেত দু’‌টাকায়, হাঁসের ডিমের জোড়া ঘোরাফেরা করত আড়াই টাকায়। আজ এক জোড়া মুরগির ডিম ১০–‌এর নিচে কলকাতার বাজারে মিলবে না। হাঁসের ডিম একটার দাম সাত থেকে আট। তাহলে কেন রোলের দোকান, যা এক সময় গোটা রাজ্য ছেয়ে ফেলেছিল, আজ কেন এত কম, তার উত্তর রয়েছে ডিমের দামে।

একই কারণে নুডলসের দামও গত বিশ বছরে এতই বেড়েছে যে বাঙালির চীনে–‌শেফ হওয়ার সাধ বলতে গেলে ঘুচে গিয়েছে। আর যদি হিসেব কষি তাহলে বলব পঞ্চাশের দশকের দু’‌আনার ঢাকাই পরোটা, ষাটের দশকের ছ’‌আনার মোগলাই পরোটা বা সত্তর দশকের পাঁচসিকির সেই পরোটা ও কাবাবের খরচেই আজ থালা ভর্তি রঙিন ভাতের সঙ্গে বড় এক পিস মুরগি বা পাঁঠার মাংস, একটি কুক্কুটান্ড এবং একটি চন্দ্রমুখীর চাঁদপানা আধখানা দামে, মানে ও ভারে একই। ঢাকাই, মোগলাই বা কাবাবের সঙ্গে পরোটা সবই ছিল আটা বা ময়দার বড় সাইজের তক্তি।

বাঙালির (‌এর মধ্যে হিন্দু বা ‘‌মুসলমান’‌ বলে কোনও ভেদ নেই)‌ রসনা, মনন ও উদর যেভাবে অন্নে তৃপ্ত হয় ময়দা বা আটায় তার ভগ্নাংশও হয় না। এ আমার কোনও মনগড়া দাবি নয়। পঞ্চাশ–‌ষাটের দশকে প্রফুল্ল সেন তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্ব জামিন রেখে এই সত্যের সন্ধান পান। একই সত্যের মুখোমুখি হন আর এক খাদ্যমন্ত্রী, পরে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ। ১৯৬৭ সালে। আর হাল আমলে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। রেশন দোকানে ঈষৎ ভাল চালের পাশে পাঞ্জাবের সেরা লাল গমের বস্তা থাকলেও চাল উড়ে যায়, গম থাকে পড়ে।

আর দাম যখন একই, তখন বাঙালি এক থালা ভাতে ঢাকা ডিম, মাংসখণ্ড ও আলু দিয়ে বানানো বীরভোগ্যা বিরিয়ানি ছেড়ে কোন দুঃখে রোল চিবুবে?‌ চিবুচ্ছেও না। বাজার এখন পুরোপুরি বিরিয়ানির দখলে। সে দীঘা হোক বা দার্জিলিং, স্লোগান আজ একটাই:‌ চেঙ্গিজ, তৈমুর, বাবরের প্রার্থনা পূরণে যা সফল বাঙালির ঘরে ঘরে চাই সেই বিরিয়ানি।‌‌‌‌‌ বাঙালির আজ বিরিয়ানি ছাড়া হারানোর আর কিছু নেই।‌‌


    সৌজন্যেঃ আজকাল